‘মন বসে না শহরে, ইট পাথরের নগরে’-
এই মুহূর্তে শহরে মন না টিকলে, সাগর যাওয়া হোক চাই না হোক, ‘ফুলেরা’ গেলেই মন ভাল হয়ে যেতে পারে দেশবাসীর | নেপথ্যে আমাজন প্রাইমের চোখ জোড়ানো সিরিজ পঞ্চায়েত | পঞ্চায়েতের সিগনেচার টিউন বেজে উঠলেই যেন মনে হয়, এক ছুট্টে যদি ফুলেরা যাওয়া যেত ….
পঞ্চায়েত সিরিজ মুক্তি পাওয়ার আগে অবধিও, রাজ্যবাসীর কাছে ‘পঞ্চায়েত’ শব্দের এক অন্য মানে ছিল | টাইমমেশিনে চড়ে রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিকে তাকালেই ‘সন্ত্রাস’এর রক্তাক্ত ছবি দেখে গা শিউরে উঠবে|
কিন্তু সিরিজের পঞ্চায়েতে বিধায়ক একটি কুকুর বা পায়রা মারলেও, তাঁকে ছেড়ে কথা বলা হয় না, সেখানে ভালবাসার ভাষা ‘চা’, পার্টির অর্থ মাদুর পেতে, হ্যারিকেন জ্বালিয়ে নিখাদ আড্ডা আর একটু আধটু মদ্যপান, লড়াইয়ের অস্ত্র একটি বাঁশ অথবা সপাটে একটি চড়, ভাতার মানে প্রয়োজন, বিশ্বাসের অর্থ বন্ধুত্ব , আর উপহার লাউ |
হিংসা হানাহানি ভেদাভেদের এই কঠিন সময়ে , ‘ফুলেরা’ ঠিক যেন ‘এক রূপকথারই দেশ, ফাগুন সেথায় হয় না কভু শেষ’ ….
সিরিজের প্রতিটা চরিত্র নিজগুণে স্বকীয়, তাঁরা শিখছেন, শেখাচ্ছেন, লড়ছেন, কাঁদছেন, হাসছেন, ভেঙে পড়ছেন উঠে দাঁড়াচ্ছেন… কেবল ফুলেরার জন্য| ২০২০থেকে ২০২৪, চার বছরের ব্যবধানে মোট তিনটে সিজন প্রকাশ্যে এসেছে পঞ্চায়েতের| কিন্তু সিরিজের সারল্যে, ভাটা পড়েনি বিন্দু মাত্র | সহজ, সাধারণ, ছোট্ট ছোট্ট অনুভূতির মিশেলে প্রধান জি, সচিব জি , থেকে শুরু করে প্রহ্লাদ চা, রিঙ্কি, বিকাশ, বিনোদ, ভূষণরা যেন আমাদের আশেপাশেরই জীবন্ত চরিত্ররা |
সিরিজে তথাকথিত স্টার কাস্টের ধার ধারেননি পরিচালক| বরং বলা ভাল, এই সিরিজে অভিনয়ের পরেই চরিত্ররা হয়ে উঠেছেন কার্যত উজ্জ্বল ‘তারা’
সিরিজের প্রধান জি, সচিব জি , থেকে শুরু করে প্রহ্লাদ চা, রিঙ্কি, বিকাশ, বিনোদ, ভূষণদের পঞ্চায়েত অবধি লড়াইটা মোটেই সহজ ছিল না| আজ এডিটরজি বাংলার পর্দায় আলোচনায় ফুলেরাবাসীর চরিত্রদের বাস্তব জীবনের লড়াই|
Dev-Prosenjit: 'কাছের মানুষ', দেব-এর ভাল কাজের সঙ্গী এবার বুম্বা'দাও
সচিব জি:
সচিব জি ওরফে জিতেন্দ্র তিওয়ারি | অভিনেতা হওয়ার আগে বছর তেত্রিশের এই যুবকের পরিচয় ছিল সম্পূর্ণ অন্য| অত্যন্ত মেধাবি এই অভিনেতা ছিলেন খড়গপুর আইআইটির ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র| লেখাপড়ার পাশাপাশি টুকটাক নাটকে অভিনয় করতেন জিতেন্দ্র| আট মাস চাকরিও করেন ইঞ্জিনিরিং সেক্টরে, কিন্তু বেশি দিন পেরে ওঠেননি, এরপর অভিনয় শুরু করেন| প্রথম দিকে, অর্থের জন্য ফিজিক্স এবং অঙ্কর টিউশনিও করতেন জিতেন্দ্র | তারপর পর্দায় তিনি ‘পড়ালেন’, সৌজন্যে ‘কোটা ফ্যাক্টরি’. তারপর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি জিতু ভাইয়াকে|
ভূষণ:
তাঁর অভিনয় দেখে দর্শকদের রাগে গায়ের লোম খাঁড়া হয়ে গিয়েছে, আর এখানেই বোধহয় জিতে গিয়েছেন অভিনেতা দুর্গেশ কুমার| তুখোড় অভিনেতা, তবু কাজ পেতে লোকের পায়েও ধরতে হয়েছে তাঁকে | ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা থেকে পাস করার পর, হাইওয়ে সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন, সম্প্রতি ‘লাপাতা লেডিজ’এও তাঁর অভিনয় প্রসংশিত | অথচ পঞ্চায়েতের প্রথম সিজনে মাত্র এক দিনের কাজ পেয়েছিলেন তিনি| কিন্তু সিজন থ্রি, তিনি ছাড়া কার্যত অসম্পূর্ন |
প্রহ্লাদ চা:
প্রহ্লাদ চা হাসলে দর্শকদের মন ভাল, কাঁদলে দর্শকদের চোখেও জল| নিজের অভিনয়ে মানুষের বুকের মধ্যে আবেগের এক পাহাড় তুলে দিতে পেরেছেন অভিনেতা ফয়জল মালিক | তথাকথিত ‘নায়ক নায়ক’ দেখতে নয় তাঁকে, তাই আলো ঝলমলে বলিউডের তাঁকে চিনতে অনেকটাই সময় লেগে গিয়েছে | বাবা ছিলেন কেরানি, দিদি মারা গিয়েছিলেন কিডনির সমস্যায়, বোন করেছিলেন আত্মহত্যা| ভেঙে পড়েছিলেন ফয়জল| মাঝপথে লেখাপড়া ছেড়ে অভিনয়ের জন্য ছোটেন মুম্বই, চেহারার জন্য একের পর এক অডিশনে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় | 700 টাকার বিনিময়ে একটি চ্যানেলে স্পটবয়ের কাজও করেছেন| তারপর দুএকটা কাজ পেতে শুরু করেন ফয়জল| এখন প্রথম সারির ওটিটিতে তিনি দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন |
বিনোদ:
‘দেখ রাহা হ্যাঁ না বিনোদ’, এই সংলাপ এখন সকলের মুখে মুখে| চরিত্রের নেপথ্যে অশোক পাঠক| অভাবী ঘরের ছেলে, সম্প্রতি হেঁটে এলেন কানের গালিচায়| ক্লাস নাইন থেকেই অভাবের তাড়নায় তুলো বিক্রি করতেন বিনোদ| মুম্বই শহরে এগারো বছরের লড়াই, বাবা দিন মজুর| যখন চোখে স্বপ্ন নিয়ে মুম্বইয়ে আসেন, তখন বন্ধুরা কম মসকরা করেননি| কিন্তু আজ হয়ত সেই অশোককে নিয়েই তৎকালের বন্ধুদের গর্বের শেষ নেই|
বিকাশ:
চন্দন রায়, বিহারের ছেলে| তাঁকে ছাড়া সচিবজি, প্রধানজি কার্যত অন্ধ | জানলে অবাক হবেন, চন্দনের এই চরিত্রটি করার কথাই ছিল না, সামান্য একটি ইলেকট্রিশিয়ানের চরিত্রের অডিশনে এসে তিনিই হয়ে ওঠেন পঞ্চায়েতের ‘বিকাশ’
রিঙ্কি:
ভাল নাম ‘সানভিকা’, বাবা মায়ের মোটেই ইচ্ছে ছিল না মেয়ে অভিনেত্রী হোক, ব্যাগ গুছিয়ে মুম্বই পালিয়েছিলেন অভিনেত্রী| প্রথম সিজনের একেবারে লাস্ট এপিসোডে মাত্র এক দুমিনিটের স্ক্রিন পেয়েছিলেন তিনি, আর সিজন থ্রিতে তিনিই সব| তবে এই জার্নিটা খুব একটা সহজ ছিল না|
সব মিলিয়ে সিরিজের ছোট থেকে বড় সব চরিত্রই স্বকীয়, অনন্য, অপূর্ব- সে রিলে হোক বা রিয়েল|