রঙ্গমঞ্চের একচেটিয়া সম্রাজ্ঞীকে সেদিন যোগ্য সম্মান দিতে ঠিক কোথায় বেধেছিল বাংলার তৎকালীন নাট্যকার গিরিশ ঘোষের? সেকথা আত্মজীবনী 'আমার কথা’য় লিখেছেন খোদ বিনোদিনী দাসীই। বইয়ের ভূমিকায় বিনোদিনী লিখছেন, “এ পৃথিবীতে আমার কিছুই নাই, অনন্ত নিরাশাময়, কাতরতা জানাইবারও লোক নাই; কেননা, আমি সংসার মাঝে পতিতা বারনারী! আত্মীয়বন্ধুহীনা কলঙ্কিনী! “ অথচ এই কলঙ্ক তো তাঁর বয়ে বেড়ানোর ছিল না।
‘বিনোদিনী’, এই নামটার স্বীকৃতি দিতে এই বাংলার প্রায় ১৪১ বছর লেগে গেল। অথচ স্টার থিয়েটারের রেজিস্ট্রেশনের সময়ও বিনোদিনী জানতেন, তাঁর নামেই হবে নবনির্মিত থিয়েটারের নাম। কিন্তু, হয়নি। কথা রাখেননি নটীর নাট্যগুরু গিরীশ ঘোষ। বিডন স্ট্রিটের স্টার থিয়েটার আগুন লাগার পর উঠে এল হাতিবাগানে, তারপরেও মেলেনি স্বীকৃতি। প্রায় ১৪১ বছর পর, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণায় স্টারের নাম হল ‘নটী বিনোদিনী থিয়েটার!’
যদিও এই স্বীকৃতির আগে থেকেই, ‘নটি বিনোদিনী’র জীবন-লড়াই গোটা বিশ্বকে জানানোর জন্য লড়ছেন অভিনেত্রী রুক্মিণী মৈত্র। ২৩ জানুয়ারি পর্দায় মুক্তি পেতে চলেছে রামকমল মুখোপধ্যায় পরিচালিত ছবি 'বিনোদিনী'। দিনের পর দিন নিজেকে বিনোদিনী হিসেবে গড়েপিটে নিয়েছেন রুক্মিণী। পর্দায় তাঁকে ফুটিয়ে তুলতে সাধনা করেছেন দীর্ঘদিন। এই মুহূর্তে, ছবির প্রচারে তাঁকে অভিনব এক রূপে পাওয়া যাচ্ছে। কখনও বেলুড় মঠ-এ দুহাত উপরে তুলে নাম সংকীর্তন করছেন তিনি কখনও আবার নিজের পোস্টার নিজের হাতেই সেঁটে দিচ্ছেন দেওয়ালে দেওয়ালে।
বিনোদিনীও এভাবেই তো লড়েছিলেন নিজের কাজের জন্য। সারা সমাজ যখন তাঁর বিরুদ্ধে, কেবল নিজের কাজের উপর ভরসা রেখেছিলেন তিনি, ভরসা রেখেছিলেন নিজের প্রতিভার উপর। তবুও একজন ‘মহিলা’র বাইরে তাঁকে সমাজ আলাদা করতে পারল না। সেই লড়াই বোধহয় এখনও জারি হালের বলিউডেও। পারিশ্রমিক হোক কিংবা পোস্টারে মুখ, সব ক্ষেত্রেই অভিনেতাদের থেকে পিছিয়ে থাকতে হয় অভিনেত্রীদের। এর বিরুদ্ধেও সোচ্চার হবে রুক্মিনীর ছবি বিনোদিনী।
পর্দার ‘বিনোদ’ রুক্মিণী, মুখ্যমন্ত্রীকে ৫ পাতার লম্বা চিঠি লিখে স্টারের ‘বিনোদিনী’ স্বীকৃতি চেয়েছিলেন অভিনেত্রী। তার ঠিক দিন দুই পরেই সন্দেশখালির সভা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্টার থিয়েটারের নাম বিনোদিনী বলে ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেদিন ঠিক কোথায় আটকেছিল?
১৪৫ নং, কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে নিষিদ্ধপল্লির এক ছোট্ট ঘরে জন্ম নেন বিনোদিনী। পিতৃপরিচয়হীন এই মেয়ে এরপর নিজের পরিচয় তৈরি করলেন নিজেই। স্বয়ং ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ স্টার থিয়েটারে এসে বারাঙ্গনা বিনোদিনীর মাথায় হাত রেখে বলে গিয়েছেন, ‘মা তোর চৈতন্য হোক’। নারী পুরুষ সব অভিনয়েই তিনি ছিলেন সাবলীল। তবুও বংশপরিচয় তাঁর প্রতিভাকেই সর্বোচ্চ হতে দিল না।
গুর্মুখ রায় যখন বিনোদিনীর নামে রঙ্গমঞ্চ গড়ে তোলার লক্ষ্যে অটুট, তখন নটীর গুরু গিরিশ ঘোষই সবার আগে বেঁকে বসেছিলেন। একজন বরাঙ্গনার নামে হবে থিয়েটার? নৈব নৈব চ। গিরিশ ডেকে বিনোদকে বলেছিলেন থিয়েটারের নাম হবে ‘বি’ থিয়েটার । কিন্তু শেষে সেই কথাও রাখেননি গিরিশ ঘোষ। তিনি তাঁর, নতুন থিয়েটার দলের নাম রাখলেন, ‘ক্যালকাটা স্টার কোম্পানি ।’ আর নতুন রঙ্গালয়ের নাম দিলেন ‘স্টার থিয়েটার ।’ সেই থেকেই ব্রাত্য থেকে গেলেন বিনোদিনী দাসী। কিন্তু প্রায় ১৫০ বছর পর, ফের তিনিই নায়িকা, তবে এবার আলো তাঁর মুখে নয় বরং তাঁর জীবনের উপর। নেপথ্যে রুক্মিণী মৈত্র। ছবির জন্য এডিটরজির তরফে অসংখ্য শুভেচ্ছা।