৭৫ বছরে পা দিল ভারতের স্বাধীনতা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নাগপাশ ছিন্ন করার যে লড়াই, তাতে ভগৎ সিং, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু-সহ অসংখ্য পুরুষ বিপ্লবী যেমন সামনের সারিতে ছিলেন, তেমনই স্বাধীনতা আনতে চেয়ে রক্ত ঝরিয়েছেন অসংখ্য নারী৷ মাতঙ্গিনী হাজরা, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, লক্ষ্মী স্বামীনাথন- এই তালিকা শেষ হওয়ার নয়। ঠিক তেমনই, স্বাধীনতার পর নতুন ভারত গড়তে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন মেয়েরা। রাজনীতি থেকে শিক্ষা, আমলাতন্ত্র থেকে মহাকাশ বিজ্ঞান- কোনো কিছুতেই আর পিছিয়ে নেই তাঁরা৷ দেশের সেনাবাহিনীর সামরিক উর্দি গায়ে চাপিয়ে তাঁরা যেমন রক্ষা করছেন সীমান্ত, তেমনই নীল আকাশের বুক চিরে বিমান নিয়ে পাড়ি দিচ্ছেন বহুদূর। শুধু তাই নয়, ব্যক্তিগত পরিসরেও বাধা ভাঙছেন তাঁরা৷ যে কাজগুলিকে আগে 'ছেলেদের কাজ' বলে মনে করা হত, এখন সে সবেও সরব উত্থান মেয়েদের। তাঁরা যেমন বাস চালাচ্ছেন, রাস্তায় 'পিংক অটো' ছোটাচ্ছেন, তেমনই অংশ নিচ্ছেন একদম তৃণমূল স্তরের প্রশাসনে। সম্পূর্ণ মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত থানা এখন অনেকগুলি।
ধরা যাক রাজনীতির কথাই। জাতীয় এবং রাজ্য রাজনীতির অন্দরে এখন একের পর এক মহিলার দাপট৷ দেশের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেত্রী সনিয় গান্ধী৷ পশ্চিমবঙ্গে দাপটের সঙ্গে শাসন করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ বিজেপির অন্দরেও স্মৃতি ইরানি থেকে বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া- নারীশক্তির জয়গান চলছেই। উত্তরপ্রদেশে অত্যন্ত গুরুত্বপর্ণ চরিত্র প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী। তবে কেবলমাত্র নামজাদা মহিলাদের প্রাধান্যই কিন্তু শেষ কথা নয়। পঞ্চায়েত স্তর পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলির কাঠামোয় অসংখ্য নারী সক্রিয়। বস্তুত স্বাধীনতার ৭৫ বছরে রাজনৈতিক পরিসরে নারী শক্তির উঠে আসা এক বিরাট প্রাপ্তি।
গত কয়েক দশকে প্রতিটি পেশায় নারীদের বিপুল উত্থান পুরুষ প্রাধান্যের যাবতীয় মডেল ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে৷ মেয়েরা কেবল ঘরেই সুন্দর- এই চেনা ন্যারেটিভ সামাজিক ভাবে অনেকটাই বাতিল হয়ে গিয়েছে। কল্পনা চাওলা যেমন আমাদের সামনে মহাবিশ্বের দরজা খুলে দেন, মীরাবাঈ চানু, সাইনা নেহাওয়াল বা মেরি কম গর্বিত করেন খেলার আঙিনায়, তেমনই ততটা বিখ্যাত নন যাঁরা, সেই মেয়েরাও নতুন করে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ছেন পিতৃতন্ত্রকে।
দীর্ঘদিন পর্যন্ত গোয়েন্দাগিরিতে ছিল একতরফা পুরুষ প্রাধান্য। অথচ এই ২০২১ সালে দিল্লিতে চুটিয়ে সত্যান্বেষণ করছে উত্তরপ্রদেশের গ্রামে বেড়ে ওঠা ভাবনা পালিওয়াল। অর্থাৎ, কোনো পেশাতেই আর নেই পুরুষের মনোপলি।
২৩ বছর বয়সে স্বামী মারা যান বিনা চিকিৎসায়। সেই সময় থেকেই সুবাসীনি মিস্ত্রীর বুকে দানা বাঁধছিল একটা অদম্য জেদ। চিকিৎসা না পেয়ে যেন আর একটিও প্রাণকে ফুরিয়ে যেতে না হয়। আশি ছুঁই ছুই এক বৃদ্ধার চার দশক ধরে বয়ে বেড়ানো জেদ থেকে কলকাতার বুকেই স্বপ্নের শুরু- ‘হিউম্যানিটি হসপিটাল’।
এই বাংলারই তরুণী মনীষা পৈলান। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। প্রতিহিংসায় জ্বলে ওঠা পুরুষের ছুড়ে দেওয়া অ্যাসিডে গলে যাওয়া পুড়ে যাওয়া মুখটা ওড়না দিয়ে না ঢাকার জেদ। মনীষা মুখ ঢাকেনি কোনোদিন। কেউ এতটুকু চিড় ধরাতে পারেনি মেয়েটার আত্মবিশ্বাসে।
পার্কস্ট্রিট কাণ্ডে নিগৃহীতা সুজেট জর্ডনকে মনে আছে? সেই প্রথম সংবাদমাধ্যমকে অনুরোধ করেছিলেন, তাঁর ছবি যেন ব্লার না করা হয়। সুজেট জানতেন, তিনি নিজে অসুস্থ নন, বরং অসুস্থ এক সমাজের পাশবিকতার শিকার।
আবার একদম উলটো ছবিটার কথাও বলতেই হয়। পুরুষতন্ত্র এখনও এ দেশের রন্ধ্রে। বড় 'লিবারাল' পরিবারেও ভাই আর বোনের জন্য বেধে দেওয়া হচ্ছে আলাদা নিয়ম। এ দেশে এখনও কোনো একজনের নাম হয়ে যায় নির্ভয়া, কারো হয়তো দামিনী। অথবা অন্য কিছু। যন্তরমন্তরে হাজার হাজার প্রতিবাদীর হাতে জ্বলে ওঠা মোমবাতিরা জানে, তার নিচে কতখানি অন্ধকার৷ এখনও কাগজ খুললেই ভ্রুণহত্যা, পণের জন্য বধূনির্যাতন, নাবালিকা বিয়ের খবর৷ এখনও হয়তো আমরা অনেকেই জানি না বৈবাহিক ধর্ষণ ঠিক কী।
শিক্ষিত অধিকাংশ ভারতীয় পরিবারেই এখনও প্রথমে মেয়েদের ভাল স্ত্রী হওয়া, তারপর ভাল মা হওয়াকেই মনে করা হয় আদর্শ। মেয়েরা রোজগার করবে, হ্যাঁ করতেই হবে, তবে চাকরি হতে হবে পুরুষের পছন্দের। রাত করে বাড়ি ফিরলে, কিমবা পোশাকের ঝুল একটু কমলে চরিত্র ছানবিন হবে। বিবাহিত মহিলার কেরিয়ারে উন্নতি হলে প্রশংসা পাবে মহিলার স্বামী এবং তাঁর বাড়ির লোক। চাকরির ইন্টারভিউ দিতে আসা মেয়েটার সিভিতে সবচেয়ে আগে দেখে নেওয়া হবে তাঁর ম্যারাইটাল স্টেটাস। বিয়ে করা মেয়ে, সোলো ট্রিপে কেন? প্রেমিক ছাড়া অন্য কারোর সঙ্গে সিনেমায় কেন? ছাঁচ তৈরি করে দেবে সমাজের ওই পুরুষ মন, আর তাতেই ঢালা হবে মেয়েদের হাব ভাব, স্বভাব চরিত্র, নিয়ম কানন, এখনও এই ২০২১ এও। নারী স্বাধীনতার লড়াইটা তাই সবে শুরু। অন্তহীন এই যাত্রার শেষ বলে কিছু নেই।