লম্বায় ২০ ফুট আর ওজনে ১৫০ কেজি! এমন এক কুমিরকে নিয়ে কাঁধে করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এক ব্যক্তি। যা দেখে চোখ কপালে উঠে গেল আশেপাশের মানুষদের! ঘটনাটি ঘটেছে উত্তরপ্রদেশে। হামিরপুর জেলার অন্তর্গত পৌথিয়াখুড় গ্রামে। জানা গিয়েছে, গ্রামের একটি স্থানীয় পুকুরে গত এক মাস ধরে কুমিরটি থাকছিল। যার ফলে, গ্রামবাসীরা আতঙ্কে ওই বড় পুকুরটি ব্যবহার করতে পারছিলেন না। সেই আতঙ্কের অবসান হল অবশেষে। যে ব্যক্তি নিজের কাঁধে করে কুমিরটি নিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি আসলে বন দফতরেরই কর্মী। ভিডিয়ো ভাইরাল হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
প্রথম যে প্রশ্নটি উঠে এসেছে, তা হল- কীভাবে এবং কেন এত ঘন ঘন উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে আসছে কুমির?
বিষয়টি বুঝতে গেলে আগে জানতে হবে কী ধরনের কুমির এরা।
যে কুমিরটিকে ধরা হয়েছে এবং সাধারণত ভারতে যে ধরনের কুমির সবথেকে বেশি দেখা যায়, তা হল- সল্ট ওয়াটার ক্রোকোডাইল। অর্থাৎ, লবণাক্ত জলের কুমির। মূলত ভারতের উপকূল অঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেই দেখা যায় এই ধরনের কুমির সবথেকে বেশি। দুনিয়ায় কুমিরের মোট যতগুলো প্রজাতি আছে, তাদের মধ্যে দৈর্ঘ্যে সবথেকে বড় হয় এই ধরনের কুমির। দৈর্ঘ্য হতে পারে ২০ ফুট পর্যন্ত। কোনও কোনও পুরুষ কুমিরের দৈর্ঘ্য তার বেশিও হতে পারে। লবণাক্ত জলের পুরুষ কুমিরদের ওজন মোটামুটি ১,০০০ থেকে ১,৫০০ কেজি পর্যন্ত হয়। মহিলা কুমিরদের দৈর্ঘ্য তুলনায় কিছুটা কম হয়। সাধারণত ৮ ফুট থেকে ১০ ফুট। শুধু দৈর্ঘ্যেই নয়। দুনিয়ার কুমিরদের সব প্রজাতির মধ্যে লবণাক্ত জলের কুমিরকেই হিংস্রতম বলে মনে করা হয়। দীর্ঘতম জীবন্ত সরীসৃপ প্রজাতিও হল এই লবণাক্ত জলের কুমিররা।
রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ সহ ভারতের কিছু রাজ্যে আরও এক ধরনের কুমির দেখা যায়। যার পোশাকি নাম- 'মাগর ক্রোকোডাইল'। দেবনাগরীতে 'কুমির'কে 'মাগর মাছ' বলা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, সেই 'মাগর মাছ' থেকে এই ধরনের কুমিরের নামকরণ করা হয়েছে ইংরেজিতে। এই 'মাগর ক্রোকোডাইল'-কে এক লহমায় দেখলে আপাতদৃষ্টিতে সল্ট ওয়াটার ক্রোকোডাইল বলে ভুল হতে পারে, এতটাই মিল এদের শারীরিক গঠনে। কেবল, একটি বড় অমিল আছে। তা হল- মাগর ক্রোকোডাইল দৈর্ঘ্যে সল্ট ওয়াটার ক্রোকোডাইলের তুলনায় অনেকটাই ছোট হয়। চরিত্রগতও একটি উল্লেখযোগ্য ফারাক আছে এই দুই কুমিরের মধ্যে। সল্ট ওয়াটার ক্রোকোডাইল যতটা হিংস্র হয়, মাগর ক্রোকোডাইল ঠিক ততটাই শান্তিপ্রিয়।
কুমিরের আরও এক ধরনের প্রজাতি দেখা যায় ভারতে। অ্যালিগেটর। লবণাক্ত কুমিরের সঙ্গে এদের শারীরিক তফাতের জায়গাটা হল মুখের আকৃতি। কুমিরের মুখ হয় 'ভি'-আকৃতির। অ্যালিগেটরের মুখ হল 'ইউ'-আকৃতির। অ্যালিগেটর সাইজেও কুমিরের থেকে অনেকটাই ছোট হয়। যদিও, ভারতে অ্যালিগেটরের সংখ্যা তুলনায় অনেক কম। সবথেকে বেশি অ্যালিগেটর পাওয়া যায় আমেরিকাতে। অ্যালিগেটর মিষ্টি জলের কুমিরের প্রজাতি। লবণাক্ত জলে এরা বাঁচতে পারে না। লবণাক্ত জলের কুমিরের মতো হিংস্র না হলেও এরা অত্যন্ত দ্রুত সাঁতার কাটতে পারে। কুমিরের প্রজাতির মধ্যে সবথেকে দ্রুতগামী এই অ্যালিগেটররাই। লবণাক্ত জলের কুমিরের সঙ্গে অ্যালিগেটরের শরীরের রঙেরও পার্থক্য রয়েছে। অ্যালিগেটরের গায়ের রং হয় কালো বা গাঢ় সবুজ। কামড়ের জোরও লবণাক্ত জলের কুমিরের অনেক বেশি। এক কামড়ে ৩,৭০০ পাউন্ড পর্যন্ত চাপ দিতে পারে এই ধরনের কুমির।
কুমিরের আরও একটি ভয়ঙ্কর প্রজাতি হল 'নাইল ক্রোকোডাইল' বা 'নীল নদের কুমির'। এই ধরনের কুমির সাধারণত দেখা যায়, নীল নদে। বা, আফ্রিকা মহাদেশে। নীল নদের কুমিরের কামড়ের জোর সবথেকে বেশি। একটি কামড়ে প্রায় ৫০০০ পাউন্ড অবধি চাপ দিতে পারে। তবে, স্বভাবে এই কুমির ভয়ঙ্কর হিংস্র হয়। সামনে যে কোনও প্রাণী পড়লেই তাকে কার্যত ছিঁড়ে খেয়ে নিতে পারে এই ধরনের কুমির। আফ্রিকার বহু ছোট ও বড় নদীতেই মূলত দলবেঁধে থাকে এই ধরনের কুমির। সেই নদী কোনও প্রাণী পেরোতে গেলেই তাকে ঘিরে ধরে আক্রমণ করে এরা।আরও এক ধরনের অ্যালিগেটরের প্রজাতির দেখা যায়। যাকে বলে 'কেইম্যান'। এদের গায়ের রং সাধারণত কালো হয়। এরা সাধারণত থাকে আমাজনে।
কুমির নিয়ে জনমানসে প্রচলিত আছে বহু মিথ ও অতিকথন। তবে, প্রাণীবিদ্যা বিশারদদের মতে, আরও প্রায় সব প্রাণীর মতোই কুমিরও খিদে না পেলে বা ভয় না পেলে আক্রমণ করে না। যদিও, কুমির নিয়ে সাধারণের মনে যে আতঙ্ক তার একটা বড় কারণ সচেতনতার অভাবও বটে।
লোকালয়ে কুমির ঘন ঘন চলে আসে, তার কারণ আসলে তাদের জায়গার অভাব। যে কুমিরটিকে উত্তরপ্রদেশের হামিরপুর থেকে উদ্ধার করা হল, তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে যমুনা নদীতে। হয়তো, এমনই কোনও লবণাক্ত নদীর জল থেকেই চলে এসেছিল সেটি। তার কারণ, দেশের নদী ও নানা ধরনের জলাশয় ভরাট করতে করতে এই জলে বাস করা প্রাণীদের জন্য থাকার জায়গার সঙ্কুলান আর হয় না। মানুষের লোভের কারণেই বারবার খিদের জন্য বা বেঁচে থাকার জন্যই চলে আসতে হয় লোকালয়ে। লুকিয়ে থাকতে হয় কোনও পুকুরে বা ডোবায়।