ফারাক থেকে গেল চার দশকের। মাসটা কিন্তু সেই অক্টোবর। এতদিন অনেক আলোচনা হয়েছে তাঁদের নিয়ে। একজন, আরেক জনের প্রতিফলন বলেও অনেকে দাবি করেছেন। আলোচনা হয়েছে গেরস্তের হেঁশেল থেকে রাজনীতির কারবারিদের ঘনিষ্ঠ বৈঠকে। একজনের রাজনৈতিক লড়াই শুরু হয়েছিল হিন্দি বলয়ের জমি থেকে। আরেক জন যুদ্ধে নামলেন দাক্ষিণাত্য থেকে। এক সময় এটাও ছিল তাঁদের গড়।
ভারতীয় রাজনীতিতে ঠাকুমার পর এবার নাতনি। এ যেন এক নজির হয়ে রয়ে গেল। কেরলের ওয়াইনাড থেকে শতাব্দী প্রাচীন কংগ্রেসে শুরু হল এক নয়া অধ্যায়। ইন্দিরার পর ভোট ময়দানে এবার প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। গত বিশ বছর ধরে যে জল্পনা চলছিল, তার এবার অবসান হল বলেই দাবি করেছে রাজনৈতিক মহল।
ভোট এসেছে। ভোট গিয়েছে। প্রতিবারই তাঁর নামে গুঞ্জন তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৪ পরবর্তী সময় থেকে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর ভোটে দাঁড়ানো নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে, তা নাকি কংগ্রেসের অন্য কোনও নেতাকে ঘিরে হয়নি বলেই দাবি করেছে ওয়াকিবহাল মহল। কংগ্রেসের রক্তচাপ আরও বাড়িয়েছিল বিজেপি। প্রতি ভোটেই হয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রিয়াঙ্কার নাম ঘোষণার জন্য চাপ বেড়েছে কংগ্রেসের উপরেই।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রচারক হিসাবে গত লোকসভা ভোটে প্রিয়াঙ্কার স্ট্রাইক রেট ১০০। বিশেষ করে, উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক হিসাবে ইন্ডিয়া জোটকে যে ভাবে তিনি নেতৃত্ব দেন, তাতে চমকে গিয়েছিলেন বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতারা। শিক্ষানবীশ হিসাবে রাজনৈতিক জীবন শুরু। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে যোগী ভূমে কংগ্রেসের হাত শক্ত করার কারিগড় ইন্দিরার নাতনি।
ওয়াইনাড তারই ইনাম। গত লোকসভায় দুটি কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। তার মধ্যে একটি ছিল কেরলের এই সংসদীয় কেন্দ্র। ইন্ডিয়া জোট হলেও এই কেন্দ্রে রাহুলকে লড়াই করতে হয়েছিল বামেদের বিরুদ্ধে। এবারও প্রিয়াঙ্কাকেও সেই একই লড়াই লড়তে হবে। তবুও, কংগ্রেস মনে করছে সংসদে প্রিয়াঙ্কার অভিষেকের জন্য এটাই সেরা সময়। এবং ওয়াইনাড সেফ আসন।
মা সনিয়া গান্ধী, দাদা রাহুল গান্ধীকে সঙ্গে নিয়ে নিজের যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেছেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। রাজনৈতিক মহলের মতে, তাঁকে এবার ভোট ময়দানে যে আনা হবে, সেই ইঙ্গিত অনেক আগে থেকেই দিয়েছিল কংগ্রেস। সেই জন্য প্রিয়াঙ্কাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে। কংগ্রেসের এই কৌশলে তখন অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। গত জুন মাসে প্রিয়াঙ্কার জন্য ওয়াইনাড ছেড়ে, সেই উত্তর দিয়েছিলেন রাহুল।
মনোনয়নে দাখিল প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর সম্পত্তি থেকে স্পষ্ট তিনি কোটিপতি প্রার্থী। দাবি নির্বাচন কমিশনের। গত অর্থবর্ষে তাঁর মোট আয় ৪৬ লক্ষ ৩৯ হাজার টাকা। স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ১২ কোটি টাকা। এরমধ্যে, অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে ৪ কোটি ২৪ লক্ষ টাকা। সোনার গয়নার পরিমাণ ১ কোটি ১৫ লক্ষ টাকার মতো। অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ৭ কোটি ৭৪ লক্ষ টাকা। রয়েছে তিনটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, পিপিএফ। বাড়ি রয়েছে হিমাচল প্রদেশে শিমলায়। যার আনুমানিক মূল্য ৫ কোটি ৬৩ লক্ষ টাকা।
আজ থেকে ২০ বছর আগে। ২০০৪ সালে প্রথম ইউপিএ সরকার আসার আগে একজন শিক্ষানবীশ হিসাবে রাজনীতি শুরু করেছিলেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। সেইসময় অনেকেই হেসেছিলেন। কারণ, রাজনীতিতে শিক্ষানবীশ প্রিয়াঙ্কা ! যে পরিবার ভারতকে সেরা তিন প্রধানমন্ত্রী উপহার দিয়েছে। যে পরিবারের রাজনীতিই ইউএসপি। এরপরেও রাজনীতি শিখবেন প্রিয়াঙ্কা। তিনি শিখেছেন। তার প্রমাণ-ই বিশ বছর পর ওয়েনাডে তাঁকে প্রথমবার ভোট ময়দানে নামানোর সিদ্ধান্ত।
আর এই বিশ বছরে দীর্ঘ লড়াই করতে হয়েছে বঢড়া-পত্নীকে। ২০১৯ সালে সরকারি ভাবে কংগ্রেসে যোগ প্রিয়াঙ্কার। কাজ শুরু আমেঠি ও রায়বরেলির প্রচারক হিসাবে। এক বছর পর, উত্তরপ্রদেশে প্রিয়াঙ্কাকে নিয়োগ করা হল সাধারণ সম্পাদক হিসাবে। ২০২১ সালে লখীমপুর খেরির ঘটনা নেত্রী হিসাবে প্রথম দেখা গেল প্রিয়াঙ্কাকে। ২০২২, বিধানসভার দামামা বাজাল উত্তরপ্রদেশে। লখনউ থেকে বিরাট মিছিল আয়োজন করলেন কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। স্লোগান উঠল, লড়কি হো, লড় শক্তি হো। কিন্তু ফল প্রকাশের পর ৪০৩ আসনের মধ্যে কংগ্রেসের ঝুলিতে মাত্র দুই। ২০২৩ সালে উত্তরপ্রদেশের সাধারণ সম্পাদক হিসাবেই প্রিয়াঙ্কার উপর আস্থা রাখল কংগ্রেস। এবার লোকসভা ভোটের আগে যাবতীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হল প্রিয়াঙ্কাকে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে হাতের তালুর মতো চেনা উত্তরপ্রদেশ থাকতে কেরলের ওয়েনাডে কেন প্রিয়াঙ্কা ? যে উত্তরপ্রদেশের অলি-গলি তাঁর ধমনীতে বইছে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়ার কারণ কী ? রাজনৈতিক মহল বলছে, বিজেপিকে রুখতে দাক্ষিণাত্যে এবার একটা বলয় তৈরি করতে চায় কংগ্রেস। শতাব্দী প্রাচীন এই দলের পিছনে রয়েছে ইন্ডিয়া জোটের বাকি রাজনৈতিক দলগুলি। প্রয়োজন একজন নেতার। যাঁর গ্রহণযোগ্যতা আসমুদ্র-হিমাচল। আর সেই জায়গা থেকে প্রিয়াঙ্কা ছাড়া কংগ্রেসের কাছে অন্য অস্ত্র কোথায় ?