চোখে আর বাঁধা নেই কাপড়ের পট্টি। খুলে গেল ‘আইনের চোখ’। এক হাতে তরোয়াল এবং চোখে পট্টি নিয়ে যে ন্যায়ের দেবীর মূর্তি এত দিন প্রচলিত ছিল, তা বদলে যাচ্ছে। প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের নির্দেশে সুপ্রিম কোর্টে ইতিমধ্যে নতুন মূর্তি বসে গিয়েছে। নতুন এই নারীমূর্তির চোখে কালো পট্টি নেই। তার এক হাতে রয়েছে দাঁড়িপাল্লা, অন্য হাতে তরবারির বদলে রয়েছে ভারতের সংবিধান। গাউন ছেড়ে শাড়ি পরলেন ন্যায়দেবী। এখানেও ভারতীয়করণ।
ন্যায়ের দেবীর চির পরিচিত প্রাচীন মূর্তিটির সঙ্গে লেগে রয়েছে রোম এবং মিশরের ইতিহাস। সেই যোগ ছিন্ন করে দেশের ন্যায়ের প্রতিমূর্তিতে বদল আনল ভারতীয় বিচারব্যবস্থা।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের লাইব্রেরিতে ন্যায়ের নতুন মূর্তিটি বসানো হয়েছে প্রধান বিচারপতির নির্দেশে। শ্বেতবর্ণের নতুন নারীমূর্তির চোখে কালো কাপড় বাঁধা থাকত। আইনের চোখে সকলেই সমান— এই ভাবনা থেকেই বাঁধা থাকত 'ন্যায়ের দেবীর' চোখ। আদালতের কাছে বিচারাধীনের ক্ষমতা, ধনদৌলত, সামাজিক মানমর্যাদা কোনও কিছুই বিবেচ্য হয় না। সকলকে সমান চোখে দেখে বিচার করা হয়। এই বার্তা দিতেই বাঁধা থাকত চোখ। ন্যায়মূর্তির হাতের তরোয়াল ছিল আইনের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতার প্রতীক।
লেডি জাস্টিসের মূর্তি নিয়ে কিছুন কথা জেনে নেওয়া যাক। জাস্টিস শব্দটা এসেছে, জাস্টিশিয়া থেকে, রোমান পুরাণ বলে সম্রাট অগাস্টাসের চরিত্রের একটি প্রশংসনীয় দিক, তা থেকেই ন্যায় বা জাস্টিসের ধারণা আসে। ন্যায়ের দেবী মনে করা হতো জাস্টিশিয়াকে। অগাস্টাসের রাজ্যকালের পরে রোমে জাস্টিশিয়ার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন অন্য সম্রাটরা। গ্রিক পুরাণে ন্যায়ের দেবী বলা হত থেমিসকে। মিশরে আবার ন্যায়ের দেবীর নাম ছিল মাত। কম বেশি, সব সভ্যতাতেই দেখা যাচ্ছে ন্যায় দেবীর ধারণা, এবং দেবীর চেহারা একই রকম। পরনে গাউন বা রোব, চোখ বাঁধা, হাতে দাঁড়িপাল্লা, ষোড়শ শতক থেকেই লেডি জাস্টিসের এই সাজ পোশাক দেখতে অভ্যস্ত বিশ্ববাসী।
প্রতি ক্ষেত্রেই ন্যায় দেবী সত্যের পক্ষে। তাই এটুকু স্পষ্ট, যে সত্যের ধারণার ওপর ভিত্তি করেই ন্যায়ের ধারণা এসেছে। ভাবনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এখনও কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলার চল, 'যাহা বলিব, সত্য বলিব, সত্য বৈ মিথ্যা বলিব. না'। পশ্চিমী সভ্যতার only truth prevails' ,এবং ভারতীয় দর্শনে 'সত্যমেব জয়তে'-এর মাঝে আসলে ফারাক নেই।
তা, হঠাৎ ন্যায়ের প্রতিমূর্তি বদল? ঔপনিবেশিক রীতির গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছেন চন্দ্রচূড়, অনেকেরই মত তেমনই। ভারতীয় দণ্ডবিধির বদলে ন্যায় সংহিতা চালু করা হয়েছে সম্প্রতি, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই নাকি বদলে ফেলা হচ্ছে নারীমূর্তিটিকেও।
তবে, নতুন ছবি প্রকাশ্যে আসার পর সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে ন্যায়ের বন্ধ চোখ খুলে যাওয়া নিয়ে। অনেকেই বলছেন, বিচারপতি চন্দ্রচূড় মনে করছেন, আইনের চোখে সবাই সমান ঠিকই, কিন্তু আইন কখনও অন্ধ থাকতে পারে না। তরোয়ালের পরিবর্তে সংবিধান রাখার ক্ষেত্রেও এই ধরনের যুক্তি কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, তরোয়ালটি আসলে হিংসার প্রতীক। প্রধান বিচারপতির বার্তা— আইনের চোখে হিংসার কোনও স্থান নেই। বরং সংবিধান অনুযায়ী আদালত বিচার করে এবং রায় শোনায়। শাস্তি দেওয়া-ই আইনের মূল উদ্দেশ্য নয়, বরং দেশের সংবিধানকে মান্যতা দিয়ে সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার ভাবনা থেকেই বদল।
ন্যায়মূর্তির ডান হাতে দাঁড়িপাল্লাটি আগের মতোই থাকছে। ওই দাঁড়িপাল্লা সমাজের ভারসাম্যের প্রতীক। বিচার কোনও এক পক্ষের দিকে ঝুঁকে থাকে না। বাদী, বিবাদী উভয়পক্ষের যুক্তি শুনে বিচার করে আদালত।দাঁড়িপাল্লাটি সেই বার্তা দিয়ে থাকে। এত বছর ধরে ভারতের সমস্ত আদালতে লেডি জাস্টিসের মূর্তির গায়ে ছিল গাউন, পশ্চিমী পোশাক। এবার ন্যায়দেবী পরলেন শাড়ি।
আগামী ১০ নভেম্বর অবসরগ্রহণ করছেন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়। অবসর নেওয়ার আগে দেশের ন্যায়মূর্তি বদলের সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রককে চিঠি দিয়ে দেশের পরবর্তী প্রধান বিচারপতি হিসাবে বিচারপতি সঞ্জীব খন্নার নাম প্রস্তাব করেছেন বিচারপতি চন্দ্রচূড়। তাঁর অবসরের পর দেশের ৫১ তম প্রধান বিচারপতি হিসাবে শপথ নেওয়ার কথা বিচারপতি খন্নার।
এই মুহুর্তে সারা দেশকে নাড়িয়ে দেওয়া আরজি কর কাণ্ডের মামলা চলছে সুপ্রিম কোর্টে। বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বে তিন বিচারপতির বেঞ্চ সেই মামলার শুনানি করছে। শুনানির পরবর্তী দিন ধার্য হয়েছে।
ঔপনিবেশিকতার গন্ধ পুরোপুরি মুছে সময়োপযোগী করতেই নতুন আইনের প্রবর্তন বলে দাবি বর্তমান সরকারের। সেই লক্ষ্যেই ১৮৬০ সালের ইন্ডিয়ান পিনাল কোড (Indian Penal Code, 1860 ) বদলে হয়েছে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (Bharatiya Nyaya Sanhita বা BNS) ও ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট (Indian Evidence Act,1872) হয়েছে ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম (Indian Sakshya Act বা ISA), আর ক্রিমিনাল প্রোসিডিওর কোড (Criminal Procedure Code,1898) প্রতিস্থাপিত হয়েছে ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা (Bharatiya Nagarik Suraksha Sanhita Act বা BNSS) নামে।
আইপিসি বা ভারতীয় দণ্ডবিধিতে-তে ৫১১টি ধারা ছিল। বিএনএসে ধারা রয়েছে ৩৫৮টি। একই ধরনের অপরাধের পার্থক্য অনুযায়ী বিভিন্ন ধারা ছিল আইপিসি তে। নতুন আইনে একই ধরনের বিভিন্ন অপরাধকে এক ছাতার তলায় আনায় ধারার সংখ্যা কমেছে।
ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় বেশ কিছু অপরাধের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান অনেক কড়া হয়েছে। বিশেষ করে মহিলা এবং শিশুদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের বিচারের আইনের ধারাগুলিকে আরও জোরদার করা হয়েছে। বৈবাহিক ধর্ষণের মতো একাধিক বিষয় নতুন ভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। গণধর্ষণের ঘটনায় শাস্তির বিধান বাড়ানো হয়েছে। শ্লীলতাহানির সংজ্ঞার পরিসর বেড়েছে। জিরো এফআইআর-এর বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে নতুন আইনে। ই-এফআইআর নিয়েও স্পষ্ট নির্দেশিকা রয়েছে। সমকামিতাকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করা ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ নম্বর ধারা অবলুপ্ত হয়েছে ভারতীয় ন্যায় সংহিতায়।
আইপিসি বদলে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা লাগু হল, সুপ্রিম কোর্টে বসল নতুন ন্যায়মূর্তি। দু'টি ক্ষেত্রেই কিন্তু একটা ভাবনা স্পষ্ট। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, বিচারব্যবস্থার ভারতীয়করণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।