ভূতে বিশ্বাস করেন ? ভূত কি সত্যিই আছে ? ভূতে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস সবটাই ব্যক্তি নির্ভর বিষয় । রাতের অন্ধকারে যদি শ্মশান বা কবর স্থানের পাশ দিয়ে যান, তাহলে খুব সাহসীদেরও যে গা ছমছম করবে না বলাটা ভুল । তবে একটা কথা ঠিক যে, ভূত নিয়ে মানুষের কৌতূহল কম নেই ।
শোনা গিয়েছে, তেনাদের চোখে দেখা যায় না । শুধু অনুভব করা যায় । তবে, অনেকে নাকি সচক্ষেও তেনাদের দেখেছেন । কখনও ছায়া মূর্তি, কখনও সাদা শাড়ি পরা অবয়ব...কত কী শোনা যায় । আকাশবাণীতে কাজ করার সময় প্রয়াত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়েরও নাকি ভূত দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল । বিখ্যাত সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় প্রচুর ভূতের গল্প লেখেন । তবে, তিনি নাকি বহুবার নেগেটিভ কিছু অনুভব করেছেন । শীর্ষেন্দু নিজেই জানিয়েছেন, ভূতে তাঁর বিশ্বাস রয়েছে । অনেকে আবার বলেন, জগতে যেমন পজিটিভ এনার্জি আছে, তেমন নেগেটিভও আছে । সে যাই হোক, ভূত নিয়ে গবেষণা আমাদের প্রতিবেদনের বিষয় নয় । তবে, জানেন কি, শহর কলকাতায় ভূতেদের প্রচুর আস্তানা রয়েছে । সেসব জায়গা দিয়ে হয়তো বহুবার যাতায়াত করেছেন, অনেকে আবার ঘুরেও এসেছেন । কিন্তু সন্ধে নামলেই নাকি সেখানে অশরীরীদের আনাগোনা শুরু হয় । যদিও তা কতটা সত্যি, জানা নেই । তবে বছরের পর বছর ধরে কলকাতার মোস্ট হন্টেড প্লেস অর্থাৎ ভুতুড়ে জায়গার তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে বেশ কয়েকটি নাম । তার মধ্যে রয়েছে ন্যাশনাল লাইব্রেরি, রবীন্দ্র সদন, হেস্টিংস হাউজ, খিদিরপুর ডক-সহ একাধিক স্থান । আজ এডিটরজি বাংলার প্রতিবেদনে রইল শহরের বুকে ১০ ভূতুড়ে স্থানের খোঁজ
ন্যাশনাল লাইব্রেরি
ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগার । ১৮৮ বছরের পুরনো একটি ভবন । যেখানে দেশ-বিদেশ, বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন রকম বইয়ের সম্ভার । আলিপুরে বেলভেদর রোডে অনেক ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সাক্ষ্মী সাদা ভবনটি । তবে,সন্ধে নামলেই নাকি সেখানে নানারকম ভৌতিক কাণ্ডকারখানাও ঘটে চলে প্রতিনিয়ত । ব্রিটিশ শাসন চলাকালীন ন্যাশনাল লাইব্রেরি ছিল গভর্নর জেনারেলের বাসভবন । অনেকে বলেন, তৎকালীন গভর্নর জেনারেল চার্লস মেটকাফের স্ত্রী লেডি মেটকাফের আত্মা নাকি এখনও ঘুরে বেড়ায় ন্যাশনাল লাইব্রেরির আনাচে-কানাচে । অনেক রক্ষী নাকি রাতের অন্ধকারে এক মহিলার কান্না শুনতে পান । লেডি মেটকাফ সবসময় সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে ভালবাসতেন । ন্য়াশনাল লাইব্রেরির বহু রক্ষীকে এমনও বলতে শোনা গিয়েছে, রাতভর নাকি বই আর বইয়ের তাক পরিষ্কার করেন তিনি । আদৌ তা কতটা সত্যি জানা নেই, তবে, রাতের বেলা ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে একটা গা ছমছম পরিবেশ থাকে ।
রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো
মেট্রো স্টেশনে আত্মহত্যা বা আত্মহত্যার চেষ্টা । প্রায়ই এমন খবর শোনা যায় । বহু তথ্য থেকে জানা গিয়েছে, রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশনেই আত্মহত্যার সংখ্যা সবথেকে বেশি । শোনা যায়, রবীন্দ্র সরোবর থেকে যাঁরা শেষ মেট্রো ধরেছেন, তাঁদের নাকি অনেকেই অদ্ভুত কিছু অভিজ্ঞতার সাক্ষ্মী থেকেছেন । কখনও কেউ ছায়ামূর্তি সরে যেতে দেখেছেন, কখনও শোনা গিয়েছে চিৎকার । সত্যিই কি এমন ঘটে? রবীন্দ্র সরোবর শেষ মেট্রো ধরে একবার সেই ভৌতিক অভিজ্ঞতা করে দেখবেন নাকি ?
হেস্টিংস হাউজ
ব্রিটিশ আমলে গর্ভনর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের বাসভবন ছিল হেস্টিংস হাউজ । বর্তমানে সেটি এখন মহিলা কলেজ । সেখানকার ছাত্রীরাই কলেজে নানারকম ভূতুড়ে কাণ্ড-কারখানার সাক্ষ্মী থেকেছেন । এক সাহেবকে ঘোড়ায় চড়ে কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেখেছেন অনেকে । তিনি আর কেউ নয় স্বয়ং হেস্টিংস সাহেব! এমনটাই বিশ্বাস করা হয় । হেস্টিংসের আত্মাই নাকি সেখানে ঘুরে বেড়ায় ।
পার্ক স্ট্রিট গোরস্থান
সত্যজিৎ রায় তাঁর ফেলুদা সিরিজে আগেই বলে দিয়েছিলেন 'গোরস্থানে সাবধান' । জানেন কি, কলকাতার ভুতুড়ে জায়গাগুলির মধ্যে প্রথম সারিতেই রয়েছে পার্ক স্ট্রিটের গোরস্থান । সত্যজিৎ রায়ের গল্পেও পার্ক স্ট্রিটের সেই গোরস্থানের কথাই বলা হয়েছে । জানা গিয়েছে, ওই গোরস্থানে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মৃত ব্রিটিশ সেনাদের কবর রয়েছে । শোনা যায়, সেখানে গিয়ে একদল বন্ধু ছবি তুলেছিল । পরে দেখা গিয়েছিল ছবিতে রয়েছে এক অদ্ভুত ছায়ামূর্তি । এমনকী, ছবিগুলি যাঁরা তুলেছিলেন, তাঁদের পরে হৃদরোগে মৃত্যু হয় । অথচ তাঁদের হার্টের কোনও সমস্যা ছিল না ।
আকাশবাণী
অশরীরীদের আনাগোনা রয়েছে আকাশবাণীতে । রাত গভীর হলেই আকাশবাণীর ফাঁকা স্টুডিওতে স্যুট পরে সাহেবদের কাজ করতে দেখা গিয়েছে । প্রয়াত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজের চোখে এক সাহেবকে দেখেছিলেন । আবার অনেকসময় রাতের বেলা আকাশবাণীর স্টুডিও থেকে ভেসে আসে বিভিন্ন রকম ফিসফিসানি আওয়াজ বা যন্ত্রের সুর ।
হাওড়া ব্রিজ
কলকাতার ঐতিহ্য হাওড়া ব্রিজ । শহরের প্রাণকেন্দ্রও বলা যায় । হাওড়া ও কলকাতাকে যুক্ত করেছে এই সেতু । প্রতিনিয়ত কত হাজার হাজার মানুষের চলাচল, কত যানবাহনের কোলাহল । সেই ১৯৪৩ সাল থেকে ছুটছে । গত ৮১ বছরে কতশত ঘটনার সাক্ষ্মী হুগলি নদীর উপর ভাসমান সেতুটি । অনেকে বলেন, হাওড়া ব্রিজে নাকি নানারকম ভূতুড়ে কাণ্ডকারখানাও ঘটে । কেমন জানেন ? শোনা যায়, হাওড়া ব্রিজে নাকি প্রায়ই রাতের বেলায় সাদা শাড়ি পরে কেউ হেঁটে যান । অনেকেই সেই দৃশ্য নাকি নিজের চোখে দেখেছেন । আবারও এমনও শোনা গিয়েছে, ভোরের দিকে যে কুস্তিগীররা কসরৎ করেন গঙ্গার ঘাটে, তাঁরা নাকি অনেকে জলের উপর ভাসমান একটা হাত দেখেছেন । এমনও হয়েছে, কেউ ডুবে যাচ্ছে ভেবে যিনি সাহায্য করতে গিয়েছেন তিনি আর ফিরে আসেননি ।
রয়্যাল টার্ফ ক্লাব
১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রয়্যাল টার্ফ ক্লাব । বর্তমানে কলকাতাবাসীদের কাছে পরিচিত রেসকোর্স হিসেবে । ব্রিটিশ শাসন চলাকালীন টার্ফ ক্লাবে জর্জ উইলিয়ামস সাহেবের পাঁচটা সাদা রেসের ঘোড়া ছিল । তবে, তার মধ্যে একটি ঘোড়া ছিল সাহেবের বড় প্রিয় । সেই ঘোড়াটির নাম পার্ল । যাকে বলা হত 'কুইন অফ ট্র্যাকস' । ওই ঘোড়া নাকি প্রতিটি রেসই জিতত । তবে, একবার বার্ষিক 'কলকাতা ডার্বি'তে হারে পার্ল । সেইসময় প্রচুর টাকাও খোয়ান উইলিয়ামস । ঠিক এর পরের দিন টালিগঞ্জ রেল লাইনের ধারে পার্লের গুলিবিদ্ধ দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায় । তারপর থেকে নাকি টার্ফ ক্লাবে রাতের বেলায় ওই ঘোড়াকে মাঝে মাঝে ছুটতে দেখা যায় ।
খিদিরপুর ডক
লখনউয়ের আওধ থেকে খিদিরপুরে এসেছিলেন নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ । ব্রিটিশরা নবাবকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আওয়াধ দখল নেওয়ার বদলে তাঁরা তাঁকে লন্ডনে থাকার ব্য়বস্থা করে দেবেন সারাজীবনের জন্য । কিন্তু, সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করা হয়নি । ফলে আমৃত্যু তাঁকে কলকাতার খিদিরপুরেই থেকে যেতে হয় । তাঁর আমলেই তৈরি হয়েছিল খিদিরপুর ডক । রাত হলেই নাকি ওই ডকে ঘুরে বেড়ান অশরীরীরা । শোনা যায়, ব্রিটিশদের বিশ্বাসঘাতকতা মৃত্যুর পরেও ভুলতে পারেননি ।
রাইটার্স বিল্ডিং
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাইটার্স বিল্ডিং ১৭৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় । ১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর তিন স্বাধীনতা সংগ্রামী বিনয়-বাদল-দীনেশ তৎকালীন ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল সিম্পসনকে গুলি করে হত্যা করেন । অনেকে বলেন, এখনও রাইটার্স বিল্ডিংয়ে সিম্পসনের আত্মা ঘুরে বেড়ায় । অনেকেই নাকি কান্নার আওয়াজ, বুটের আওয়াজও শুনতে পেয়েছেন রাতের বেলায় ।
নিমতলা ঘাট
মধ্য কলকাতায় রয়েছে নিমতলা শ্মশান ঘাট । শহরের প্রাচীনতম শ্মশান ঘাটে রাতের দিকে কিছু অদ্ভুত, রহস্যময় উপস্থিতি টের পেয়েছেন অনেকে ।
কিন্তু, প্রতিবেদনের শেষে একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, ভূত কি সত্যিই আছে ? তার কি কোনও প্রমাণ বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন? কারণ, এই বিষয়ে বিশ্বজুড়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে, এখনও চলছে । তবে শেষে একটা কথা বলতেই হয়, 'বিশ্বাসে মেলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর' ।