সালটা ছিল ২০২১। প্রবল চাপ, দলে ভাঙনের পরেও বাংলায় বিপুল জনসমর্থন নিয়ে তৃতীয়বারের জন্য মসনদে ফিরল তৃণমূল কংগ্রেস। রাজনৈতিক মহল দাবি করল, রাজ্যে তাবড় বিজেপি নেতাদের আনাগোনা ধাক্কা খেল একজনের সামনে। তিনি তৃণমূল কংগ্রেসনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সবুজ ঝড়ে বিধ্বস্ত বঙ্গ বিজেপিও। তবে কি স্বস্তি ?
এর পরের দু-আড়াই বছরে এমনটা কিন্তু দাবি করতে পারল না রাজনৈতিক মহল। কারণ, এক নয়, একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল সরকারের বিরুদ্ধে। এই রাজ্য অতীতে সারদা-নারদার মতো আর্থিক কেলেঙ্কারির সাক্ষী থেকেছে। যে তদন্ত এখনও চালিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী দুই সংস্থা। রাজনৈতিক মহল দাবি করে, সেই সমাধান এখনও অধরা।
এরইমধ্যে সরকারের বিপাক বাড়ল একযোগে আরও চারটি দুর্নীতির অভিযোগে। বিরোধীরা সরব হলেন, কয়লা, গরুপাচার, নিয়োগ এবং রেশন দুর্নীতির অভিযোগে। রাজনৈতিক মহলের দাবি, এরমধ্যে কয়লা এবং গরুপাচার নিয়ে তৃণমূলের উপর চাপ ছিল ২০২১ বিধানসভা ভোটের আগে থেকেই। আর ভোটের পর চাপ দ্বিগুণ হল শিক্ষা থেকে পুরসভায় টাকায় বিনিময়ে চাকরি দেওয়ার অভিযোগে।
শুরু হল সরকারের সঙ্গে বিরোধীদের রাজনৈতিক টানাপোড়েন। আগে থেকেই আদালতে ছিল কয়লা এবং গরুপাচার নিয়ে অভিযোগ, নতুন সংযোগ হল নিয়োগের অভিযোগ। আদালতের নির্দেশেই শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলার তদন্তের দায়িত্ব নিল সিবিআই।
দিনটা ছিল ২২ জুলাই ২০২২। রাজ্যের তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ অভিনেত্রী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে হানা দিলেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আধিকারীকরা। তাঁর দক্ষিণ কলকাতার একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে হানা দিয়ে টাকার পাহাড় উদ্ধার করল সিবিআই। একজন মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠের বাড়িতে এত টাকা থাকতে পারে, তা দেখে কার্যত অবাক হল রাজ্যবাসী।
ঠিক ২৪ ঘণ্টা পর... ২৩ জুলাইয়ের ভোরবেলা। দক্ষিণ কলকাতার নাকতলা থেকে একটা খবরে কার্যত নড়ে গেল রাজ্য রাজনীতি। ফের দুর্নীতি অভিযোগে গ্রেফতারির কালি ছিঁটে রাখল রাজ্যের আর এক মন্ত্রীর গায়ে। এর আগে নারদা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছিল রাজ্যের দুই মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং ফিরহাদ হাকিমকে। এবার নিয়োগে দুর্নীতির জেরে গারদে পার্থ চট্টোপাধ্যায়। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার জালে একে একে ধরা পড়ল মেজো-সেজো-ছোট আরও মাথা।
তবে টাকা উদ্ধারের কাহিনি এখানে শেষ হয়নি। পার্থর গ্রেফতারির পরেও অর্পিতার উত্তর শহরতলীর ফ্ল্যাটে হানা দিয়ে আরও টাকার সন্ধান পেল সিবিআই। সন্ধ্যা থেকে রাতভর সেই টাকা উদ্ধারের ঘটনায় তৃণমূল কংগ্রেস কার্যত স্বীকার করল, এই ঘটনায় দলের ভাবমূর্তিতে টোল খেয়েছে।
সেদিন ছিল জন্মাষ্ঠমী। তারিখটা ছিল ১১ অগাস্ট। বীরভূমের নীচুপট্টি। হানা দিল সিবিআই। কৃষ্ণের জন্মের উৎসবে মাতোয়ার হওয়ার আগে দিল্লির দুঁদে অফিসারদের জালে বাস্তবের কেষ্ট। এবার অভিযোগ গরুপাচারের। ফের দুর্নীতির অভিযোগে বিদ্ধ হল তৃণমূল কংগ্রেস। এই তদন্তে পৃথক মামলায় অনুব্রতের সঙ্গে গ্রেফতার করা হল সুকন্যা মণ্ডল-সহ বেশ কয়েকজনকে। এর অনেক আগেই ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে গ্রেফতার করা হয়েছিল এনামূল হককে।
রাজনৈতিক মহল মনে করে, বাংলার শাসক হিসাবে দুর্নীতি মামলায় তৃণমূলের উপর চাপ দ্বিগুণ হয় গরুপাচার ও কয়লা কেলেঙ্কারিতে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে একযোগে সিবিআই ও ইডির তলবে। যার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেন অভিষেক। যেখানে টানা হয় অভিষেকের পরিবারকেও। এই ঘটনার পিছনে বিজেপির ঘৃণ্য রাজনীতির পাল্টা অভিযোগ করেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ত্রিফলা এই দুর্নীতি মামলায় গত বছর সরকারের মাথায় নতুন কাঁটা হয় রেশন। এখানেও আদালতে ধাক্কা খায় রাজ্য। এখানেও কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে তদন্তের ভার যায় ইডি ও সিবিআইয়ের ঘরে। দীর্ঘ জেরার পর গ্রেফতার করা হয় রেশন ডিলার বাকিবুর রহমানকে। তাঁকে জেরা করেই গারদে রাজ্যের তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। সঙ্গে দুই তৃণমূল নেতা শঙ্কর আঢ্য এবং বিশ্বজিৎ দাস।
রাজ্যে যখন দুর্নীতির তদন্তে রোজই শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে হানা দিয়েছেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকরা, তখনই এল সুপ্রিম কোর্টের সেই নির্দেশ। দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে আদালতে তথ্য প্রমাণ পেশ করতে না পারলে, ওই ব্যক্তিকে আটকে রাখা যাবে না।
তাহলে এই অবস্থায় কোন পথে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাজ্যে সাম্প্রতিক সময়ে চার দুর্নীতি মামলার তদন্ত। টাকা নিয়ে স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগে এখনও জেলবন্দি বহিষ্কৃত তৃণমূল কংগ্রেস নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায়। আদালতে বারবার ধাক্কা খেয়েছে তাঁর জামিনের আবেদন। তাঁর সঙ্গেই জেলবন্দি তাঁর ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। কিন্তু বাকিরা ?
রাজনৈতিক মহলের দাবি, এখানের প্রশ্ন উঠছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার ভূমিকা নিয়ে। কারণ, যে রেশন দুর্নীতির তদন্ত করতে গিয়ে এই বছরের জানুয়ারি মাসে উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালিতে আক্রান্ত হল ইডি, সেই মামলাতেই সম্প্রতি জামিন হয়ে গেল অন্যতম অভিযুক্ত বাকিবুর রহমানের। ব্যক্তিগত ৫০ লক্ষ টাকার বন্ডে জামিন পেয়েছেন বাকিবুর। একইসঙ্গে জামিন পেয়েছেন উত্তর ২৪ পরগনার দুই তৃণমূল নেতা শঙ্কর আঢ্য এবং বিশ্বজিৎ দাস। যদিও এখনও জেলবন্দি রাজ্যের প্রাক্তনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তাঁর মুক্তি এখন সময়ের অপেক্ষা বলেই দাবি তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের।
শুধু রেশন নয়, রাজনৈতিক মহলের দাবি, তদন্ত শেষের আগে নিয়োগেও ধাক্কায় খেয়েছে কেন্দ্রীয় এজেন্সি। পার্থ জেলবন্দি থাকলেও, জামিনে মুক্তি পেয়েছেন রাজ্যের দুই বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহা এবং মানিক ভট্টাচার্য। রাজ্য রাজনীতির কারবারিরা মনে করছেন, নিয়োগের মতো ঘটনায় এই দুটি জামিন নিঃসন্দেহে স্বস্তি দিয়েছে সরকারকে।
তবে, রাজ্য রাজনীতিতে এই মুহূর্তে হটকেক গরুপাচার তদন্ত মামলায় অনুব্রত মণ্ডলের জামিনের ঘটনা। প্রায় দু বছর জেলবন্দির পর সোমবার রাতে দিল্লির তিহাড় জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন তিনি। মঙ্গলবার সকালে ফিরেছেন বীরভূমের নীচুপট্টির বাড়িতে। গত ৩০ জুলাই এই মামলায় তৃণমূল জেলা সভাপতিকে প্রথম জামিন মঞ্জুর করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। গত শুক্রবার ইডির মামলাতেও তিনি রেহাই পেয়েছেন। তাঁর তিহাড় থেকে ছাড়া পাওয়ার দিনেও জামিন পেয়ে গিয়েছন এনমূল হক। আর তাঁদের আগে জামিন হয়ে গিয়েছে সুকন্যা মণ্ডলের।
তাহলে এই চার দুর্নীতি মামলায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হাতে রইল কী ? রাজনৈতিক মহলের দাবি, হাতে রইল পেন্সিল।