মফস্বলের মানুষের কাছে ট্রেন যেমন লাইফলাইন, কলকাতার মানুষের কাছে বাস । সকাল হোক বা সন্ধে, শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণ অবিরাম ছুটে চলেছে চার-ছয় চাকার যানটি । বেহালা থেকে হাওড়া যাবেন বা সল্টলেক থেকে ধর্মতলা ? বাসই ভরসা মধ্যবিত্তদের । বাস শুধু একটা যান নয়, এ শহরের প্রাণ । কলকাতার ২০০ বছরের ঐতিহ্য । কিন্তু, এবার সেই ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার পথে ? ট্রামের পর কি এবার বাসও উঠে যাবে রাজপথ থেকে ? রাজ্য পরিবহন দফতরের রিপোর্ট বলছে, গত সাত-আট বছরে শহরে সরকারি বাসের সংখ্যা প্রায় ৭০ শতাংশ কমেছে । শুধু কি সরকারি, বেসরকারি বাসের ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি । বাসের অপেক্ষায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা । কিংবা গ্যাটের কড়ি বেশি খরচ করে ক্যাব ধরতে হচ্ছে । কিন্তু, বেশি টাকা খরচ করে তো সবার পক্ষে ক্যাবে যাওয়া সম্ভব নয় । ফলে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন নিত্যযাত্রীরা । হঠাৎ কেন এই পরিস্থিতি, কলকাতার ঐতিহ্য কেন সংকটে ? বিস্তারিত আলোচনার আগে জেনে নেওয়া যাক বাসের ইতিহাস...
বাসের ইতিহাস
১৮৩০ সাল
কলকাতায় প্রথম শুরু ঘোড়ায় টানা বাস
বাসের রুট ছিল এসপ্ল্যানেড থেকে ব্যারাকপুর
বেসরকারি উদ্যোগে ১৯২২ সালে শুরু যন্ত্রচালিত বাস
বাসগুলোর নাম ছিল পথের বন্ধু, চলে এসো, মেনকা
প্রথমদিকে গঠন ছিল লরি-বাস
লরিতে কাঠের বেঞ্জ বসিয়ে যাত্রী পরিবহণ
কলকাতায় ওয়ালফোর্ড কোম্পানির আগমন
বদলে গেল বাসের গঠন
১৯২৬ সাল থেকে ছুটতে শুরু করল দোতলা বাস
বাসের রুট চালু হয় ১৯২৮ সালে
শ্রীরামপুর থেকে বাগবাজার পর্যন্ত প্রথম রুট
সময়ের সঙ্গে বাস ছুটল কলকাতা থেকে জেলা
১৯৪৮ সালে সরকারি বাস পরিষেবা চালু
১৯৮০ সালে মিনিবাস চালু
২০০৫ সালে বন্ধ ডবল ডেকার বাস
তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় বেড়েছে বাসের সংখ্যা । রাজ্য পরিবহন দফতরের রিপোর্ট বলছে, একটা সময়ে কলকাতা এবং শহরতলিতে দৈনিক ২৫০০ সরকারি বাস চলত । কিন্তু, সেই সংখ্যাটা কমে দাঁড়িয়েছে ৭০০-তে । ছবিটা আশঙ্কাজনক । শুধু কি তাই, গত ৭ থেকে ৮ বছরে প্রায় ১০০টির বেশি পরিচিতি সরকারি বাস রুটগুলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে । কোন কোন রুট বন্ধ হয়েছে, দেখে নিন
যে রুটে বাস চলে না
২ পাইকপাড়া থেকে বালিগঞ্জ
২বি বাগবাজার থেকে বালিগঞ্জ
৩৩ পাইকপাড়া থেকে চেতলা
৩৪ আড়িয়াদহ থেকে ধর্মতলা
১১ রথতলা থেকে হাওড়া
এল ২০ ব্যারাকপুর থেকে হাওড়া
এস ১৭ আড়িয়াদহ থেকে চেতলা
এল ১৪ বাগবাজার থেকে সল্টলেক
৭ হাজার থেকে সরশুনা
এল ৯ ডানলপ থেকে গোলপার্ক
এসি ৯এ গল্ফগ্রিন থেকে দক্ষিণেশ্বর
এসি ১৬ টালিগঞ্জ থেকে জনকল্যাণ
এসি ১৭ হরিদেবপুর থেকে সল্টলেক
এসি ৩৭ বি গড়িয়া থেকে এয়ারপোর্ট
এসি ৫০ গড়িয়া থেকে বেলুড় মাঠ
এসি ৫৩ সাঁতরাগাছি-পাটুলি
ভি ২ সাঁতরাগাছি-এয়ারপোর্ট
ভি ৯ টালিগঞ্জ-নিউটাউন
ভিএস ৩ এয়ারপোর্ট-বেহালা পর্ণশ্রী
পরিবহন দফতর স্বীকার করে নিয়েছে, সরকারি বাসের সংখ্যা কমেছে । তবে, সরকারের দাবি, গত দু’বছরে বৈদ্যুতিক চালিত এবং ব্যাটারি চালিত বাসও রাস্তায় নেমেছে । তবে, তার মধ্যেও আবার বহু রুটে বিদ্যুৎ চালিত বাস বন্ধ হয়েছে ।
বিদ্যুৎ চালিত বাস
ইবি১এ সাঁতরাগাছি-ডানলপ
ইবি ২ বালিগঞ্জ-জোকা
ইবি২ এ টালিগঞ্জ-করুণাময়ী
এমডব্লিউ ২ নিউটাউন-হাওড়া
শুধু সরকারি নয়, গত দুই তিন বছরে বেসরকারি বাসের সংখ্যাও কমছে । রাজ্য পরিবহন দফতরের রিপোর্ট বলছে, করোনার আগে কলকাতায় ৪ হাজার ৮৪০টি বেসরকারি বাস চলত । এখন তা কমে হয়েছে ৩ হাজার ৬১৫ । অন্যদিকে, মিনিবাসের সংথ্যা ছিল ২ হাজার ৬৪ । এখন তা কমে হয়েছে ১,৪৯৮ ।
জানেন কি, আগামী মার্চের মধ্যে আরও ১৫০০টি বাস বাতিলের খাতায় চলে যাবে । কারণ, ওই বাসগুলির বয়স ১৫ বছরের বেশি । নিয়ম মেনেই বাতিল হচ্ছে ওই বাসগুলি । যদিও, আরও ৫ বছর চালানোর দাবি তুলে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেছে বেসরকারি বাসের মালিকরা । একেই বাসের সংখ্যা কমছে, তার উপর ১৫০০-র বেশি বাস বসে গেলে, পরিবহনের ছবিটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেই প্রশ্নই উঠছে ।
বাসের সংখ্যা কেন কমছে ?
বাস মালিকরা একাধিক অভিযোগ করেছে । তাঁদের অভিযোগ, তেলের দাম বাড়লেও দীর্ঘদিন ভাড়া বৃদ্ধি হয়নি । আরও একটা কারণ হল রক্ষণাবেক্ষণের অভাব । বাস শিল্পে অনীহা প্রকাশ করছেন তরুণ প্রজন্ম । বাসের সংখ্যা কমে যাওয়ার আরও একটা কারণ হল বাস শিল্পে কমিশন প্রথা । এমনই অভিযোগ উঠেছে ।
নিত্যযাত্রীরা জানাচ্ছেন, আগের তুলনায় রাস্তায় বাসের সংখ্যা অনেক কমেছে । সরকারি বাস ডিপোগুলি থাকলেও, সেখানে বাসের দেখা মেলে না । সকালের দিকে দু-একটা বাস থাকলেও, বেলা বাড়লেই কার্যত শূন্য ডিপোগুলি ।
বিরোধীদের অভিযোগ,গণপরিবহন বলে কিছু নেই । সব টাকা লুঠ হচ্ছে । বাস চালানোরও পয়সা নেই সরকারের । রুটগুলি বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে । যদিও, পরিবহন মন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী জানিয়েছেন, সমস্যার সমাধান হবে দ্রুত । আবারও রাস্তায় নামবে একাধিক সরকারি বাস । শীঘ্রই বিএস-৬ বাস নামবে বলে জানিয়েছেন পরিবহন মন্ত্রী ।
সম্প্রতি, আরও একটা বিষয় নিয়ে চর্চা চলছে । সেটা হল বাসের রেষারেষি । দেখা যাচ্ছে, শহরের রাস্তায় বাসের রেষারেষি বেড়েছে । আর তার বলি হতে হচ্ছে ক্লাস ফোরের শিশু থেকে মাঝবয়সি, বয়স্ক মানুষদেরও । বিশেষ করে স্কুলবাস ও পুলকারগুলি দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে । সম্প্রতি, এই নিয়ে বৈঠক হয় পরিবহন দফতরে । সেখানে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, বাসের রেষারেষি বন্ধ করতে হবে ।ট্রাফিক আইন না মানলেই কড়া পদক্ষেপ করা হবে । বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালালে খুনের মামলা করা হবে । এমনকী, বাস চালকদের কমিশনও বন্ধ করে দেওয়া হবে ।
কমিশন প্রথা কী ?
বাস চালক ও কন্টডাক্টারদের মাসিক মাইনে নয়, কমিশন দেওয়া হয় । দুই গেটের বাসের চালকদের কমিশন ছিল ১২ শতাংশ আর দুই কন্ডাক্টারের কমিশন ৬ শতাংশ করে । আর বর্তমানে এক গেটের বাসের চালকের কমিশন ১৫ শতাংশ ও কন্টাডাক্টারের জন্য ৯ শতাংশ । জানা গিয়েছে, বাম আমল ও তৃণমূল সরকারের আমলে একবার কমিশন প্রথা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল । কিন্তু,অভিযোগ কোনও কাজ হয়নি । এবার কমিশন প্রথা নিয়ে কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম জানান, তিনি একটা এসওপি করার নির্দেশ দিয়েছেন যেখানে কমিশন প্রথা থাকবে না । যদিও, কমিশন প্রথা তুলে নেওয়ার বিষয়টি ভাল চোখে দেখছে না বাস সংগঠনগুলি ।