ছাপা হয়ে গিয়েছে নির্ঘণ্ট। দেওয়ালে ভোটের চুন লাগার আগেই রাজ্যের ছয় কেন্দ্রের ফল নিয়ে আগাম আত্মবিশ্বাসী বাংলার শাসক তৃণমূল কংগ্রেস। আরজি করের ঘটনার পর রাজ্যে প্রথম উপ-ভোট। এই নির্বাচন থেকে খুব কী সুবিধা করতে পারবে বাংলার শাসক দল ? এই প্রশ্নের উত্তরে খানিকটা মিশ্র রাজনৈতিক মহলের প্রতিক্রিয়া। একাংশের দাবি, এবার যে পাঁচ জেলায় ভোট হচ্ছে, তাতে কলকাতা সংলগ্ন জেলা হল উত্তর ২৪ পরগনা। গত কয়েক দিনে আরজি করের ঘটনা কলকাতা বাদ দিলে যে জেলায় প্রতিবাদের ঝড় সবথেকে বেশি, সেটা ছিল উত্তর ২৪ পরগনা। কারণ, নির্যাতিতা ছিলেন এই জেলার বাসিন্দা। এই জেলার দুটি কেন্দ্র নৈহাটি এবং হাড়োয়ায় হবে উপ-নির্বাচন।
১৩ নভেম্বর উপ-ভোটে আরজি কর খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারবে না বলেই দাবি রাজনৈতিক মহলের আর এক অংশের। তাঁদের মতে, গত ৯ অগাস্টের ঘটনা শহর কলকাতাকে আলোড়িত করলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এর কোনও প্রভাব এখনও পর্যন্ত গ্রামে নেই। আর এর জন্য বিরোধীদেরই দায়ী করছেন রাজনৈতিক কারবারিরা। আর এই কারণে উপ-ভোটেও বাংলার শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসই এগিয়ে রাখছেন তারা।
আরজি করের ঘটনার পর বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশ ছিল, কলকাতার হাসপাতালের চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনার কথা গ্রামের মানুষকেও জানাতে হবে। এই মর্মেই দিন কয়েক আগে বঙ্গ বিজেপির কাছে সেই নির্দেশ এসেছিল। কিন্তু তা কলকাতার সীমানা পেরিয়ে বাংলার প্রান্তিক অঞ্চলে গিয়েছে কীনা, তা নিয়ে একটা প্রশ্ন রয়েছে ওয়াকিবহাল মহলের মতে। তাঁদের দাবি, সম্প্রতি লোকসভা নির্বাচনের আগে বসিরহাটের ঘটনা নিয়ে শুভেন্দু-সুকান্তদের যতটা মরিয়া দেখা গিয়েছিল, আরজি কর নিয়ে যেন কেমন একটা খাপছাড়া বিজেপি। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনে ঘেঁষতে গিয়ে গো ব্যাক স্লোগান শুনেছেন পদ্ম সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এবং মহিলা মোর্চার নেত্রী অগ্নিমিত্রা পল। যার প্রভাব পড়েছে এই আন্দোলনে বিজেপির ভূমিকাতেও।
বারবার আরজি করের ঘটনা নিয়ে অরাজনৈতিক মঞ্চ তৈরির অনুরোধ করছেন রাজ্যের বিরোধী দল নেতা শুভেন্দু অধিকারী। কিন্তু তাঁর অনুরোধ সেই ভাবে রাজ্য রাজনীতিতে এখনও পর্যন্ত প্রতিফলিত নয়। রাজনৈতিক মহলের দাবি, বিরোধী দল হিসাবে এই আন্দোলনে সরকারের উপর যে চাপ সৃষ্টির প্রয়োজন ছিল, বিজেপি সেই সুযোগ হারিয়েছে।
বরং আরজি করের ঘটনার পর রাজনৈতিক মহল প্রশংসা করেছে বামেদের ভূমিকা নিয়ে। রাজ্য রাজনীতিতে শূন্য সিপিএম মমতার বিরুদ্ধে এই আন্দোলনে নিজেদের জমি শক্ত করতে এখন মরিয়া। আরজি করের প্রথম দিন থেকেই ময়দানে রয়েছেন বামেরা। ইতিমধ্যেই শাসকের অভিযোগ, আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলনে থাকা জুনিয়র ডাক্তারদের অনশনের পিছনেও রয়েছে বামেদের ইন্ধন। যা অস্বীকার করা হয়েছে আলিমুদ্দিনের পক্ষ থেকে। বরং মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে এই সমস্যার অবিলম্বে সমাধান চেয়েছেন বাম নেতারা।
তিন বছর আগে বিধানসভা ভোটের ফলে এই ছটি কেন্দ্রের মধ্যে পাঁচটিতে জিতেছিল বাংলার শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। এরমধ্যে নৈহাটি কেন্দ্রে জিতে হ্যাটট্রিক করেছিলেন রাজ্যের প্রাক্তনমন্ত্রী পার্থ ভৌমিক। তিন বছর আগে সিতাই কেন্দ্রে জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূলের জগদীশচন্দ্র বসুনিয়া। ১০, ১১২ ভোটে হারিয়ে ছিলেন বিজেপির দিলীপকুমার রায়কে। শেষ লোকসভা ভোটে জিতে এখন সাংসদ তৃণমূলের এই নেতা।
কোচবিহারের পাশের জেলা আলিপুরদুয়ার। এই জেলার মাদারিহাট আসন থেকে জিতে বিধানসভায় গিয়েছিলেন বিজেপির মনোজ টিগ্গা। এই কেন্দ্র থেকে মনোজের জয়ের মার্জিন ছিল ২৯,৬৮৫ ভোট। গত লোকসভা ভোটে উত্তরবঙ্গে পদ্ম শিবিরের মুখ এখন এই আদিবাসি নেতা।
বাঁকুড়া থেকে সদ্য সাংসদ হয়ে লোকসভায় গিয়েছেন তৃণমূলের অরূপ চক্রবর্তী। তিনিও ছিলেন রাজ্য বিধানসভার বিধায়ক। তিন বছর আগে, জেলার তালডাংরা আসন থেকে জিতেছিলেন অরূপ। তাঁর জয়ের মার্জিন ছিল ১২,৩৭৭ ভোট।
তিন বছর আগে মেদিনীপুরে মমতার চমক ছিল অভিনেত্রী জুন মালিয়া। বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের ছেড়ে যাওয়া আসনে প্রথমবার দাঁড়িয়েই বিধায়ক হয়েছিলেন জুন। জিতেছিলেন ২৪,৩৯৭ ভোটে। প্রথমবার বিধানসভায় যাওয়ার কয়েক বছরের ব্যবধানে ফের মেদিনীপুর লোকসভা আসনে জিতে এখন তিনি তৃণমূলের সাংসদ।
উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণবঙ্গ মিলিয়ে ফের রাজ্যে উপ-ভোট। সেই ভোটে সবার নজর উত্তর ২৪ পরগনার দিকে। যার মধ্যে একটি আসন বারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রে অন্তর্গত নৈহাটি। যে আসনে জিতে তিন বছর আগে রাজ্যের মন্ত্রী হয়েছিলেন পার্থ ভৌমিক। এবার তিনি বারাকপুর থেকে লোকসভার সাংসদ।
তবে, এক অন্য সমীকরণে দাঁড়িয়ে উত্তর ২৪ পরগনার আর এক কেন্দ্র হাড়োয়া। এখান থেকে বিধায়ক হয়ে প্রথম বিধানসভায় গিয়েছিলেন হাজি নুরুল। গত লোকসভা ভোটে বসিরহাট কেন্দ্রে নুসরতের গ্ল্যামার সরিয়ে এই নুরুলের উপরেই আস্থা দেখিয়েছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সন্দেশখালিকে কেন্দ্র করে উত্তাল আবহে লোকসভার ভোট জিতে মমতাকে বসিরহাট ফিরিয়ে দিয়েছিলেন হাজি নুরুল। সম্প্রতি তিনি প্রয়াত হয়েছেন। যার ফলে শুধু হাড়োয়া নয়, উপ-নির্বাচনের অপেক্ষায় এখন বসিরহাটও।
তবে ছয় বিধানসভার উপভোট মাঠে নামার আগেই, ম্যাচের রেজাল্ট ছয়-শূন্য হবে বলেই দাবি করেছেন তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ। অত সহজ হবে না বলেই দাবি বিরোধীদের। এবার প্রতিবাদের ঝড় উঠবে। এমনটাই দাবি বাম ও বিজেপির। দু দলের নেতাদের দাবি, মানুষের আন্দোলনের প্রভাব দেখা যাবে এই উপ-ভোটে।