'কিস'-মে কিতনা হ্যায় দম:
একটা সময় ছিল যখন বড় পর্দায় সামান্যতম অন্তরঙ্গ দৃশ্য দেখানো হলেও, তা নিয়ে রীতিমতো তোলপাড় পড়ে যেত। সময় পালটেছে। সময়ের সঙ্গে শিল্পের বিকাশ হয়েছে। তবে, এ কথা ঠিক যে, প্রকাশ্যে ‘চুম্বন’ নিয়ে পশ্চিমী দেশগুলি যতটা খোলামেলা, ভারত এখনও ততটা নয়। যদিও, গান, ছবি বা সাহিত্যে চুম্বন নিয়ে আড়ষ্টতা আগের মতো নেই। দুটি ফুল একে অপরের কাছাকাছি আসা থেকে ইনস্টাগ্রাম রিলের যুগ অবধি পেরিয়ে এসেছে ভারতীয় ছবির দর্শক। সাক্ষী থেকেছেন পর্দায় চুম্বন দৃশ্যে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তুমুল জড়তা থেকে চরম স্বাচ্ছন্দ্যের। বলিউডের তেমনই কয়েকটি ছবির দৃশ্য নিয়ে প্রথমে কথা বলব আমরা।
হিমাংশু রাই এবং দেবিকা রানি বিংশ শতাব্দীর ৩০-এর দশকে সাহসী দৃশ্যে অভিনয় করেছিলেন পর্দায়। ১৯৩৩ সালের 'কর্মা' ছবির জন্য লিপ-লক দৃশ্যের জন্য শ্যুট করেছিলেন তাঁরা। স্বাধীনতার আগের ওই ভারতবর্ষে শুট করা সেই দৃশ্য নিয়ে বিতর্কের ঝড় বয়ে গিয়েছিল। হিমাংশু রাই ছিলেন দেবিকারানির সহ-অভিনেতা এবং বাস্তব জীবনের স্বামী।
ঋষি কাপুর এবং ডিম্পল কাপাডিয়ার প্রথম ছবি 'ববি'। রাজ কাপুর পরিচালিত এই ছবিতে ঋষি কাপুর এবং ডিম্পল কাপাডিয়াকে গভীর চুম্বন দৃশ্যে লিপ্ত হতে দেখা গিয়েছিল। সত্তরের দশকের উত্তাল সময়ে 'ববি' হয়ে উঠেছিল সিলভার স্ক্রিনে সাহসিকতার অন্যতম প্রতীক।
জিনাত আমন তাঁর সময়ে বলিউডের অন্যতম হটেস্ট আইকন ছিলেন। 'সত্যম শিবম সুন্দরম' (১৯৭৮) ছবিতে শশী কাপুর ও জিনাত আমনের চুমুর দৃশ্যও বলিউডের অন্যতম আইকনিক চুম্বন-দৃশ্যর তালিকায় স্থান পেয়েছে।
১৯৮৮ সালে 'দয়াবান' ছবির 'আজ ফির তুমসে প্যায়ার আয়া হ্যায়' গানে বলিউডে তৎকালীন নবীন অভিনেত্রী মাধুরী দীক্ষিত সিনিয়র অভিনেতা বিনোদ খান্নার সঙ্গে একটি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ চুম্বন দৃশ্যে অভিনয় করেছিলেন। যা নিয়ে রীতিমতো শোরগোল পড়ে গিয়েছিল।
১৯৯৬ সালের ‘রাজা হিন্দুস্তানি’ ছবিতে আমির খান ও করিশ্মা কাপুরের চুমুর দৃশ্য নিয়েও জলঘোলা হয়েছিল অনেকদূর। বলিউডের বিখ্যাত খান-দের মধ্যে অনস্ক্রিন চুমুর দৃশ্যে সবথেকে বেশিবার অভিনয় করেছেন আমির খান। এই দৃশ্যটি তাদের মধ্যে অন্যতম।
২০০০ সালে মুক্তি পাওয়া ‘হে রাম’ ছবিতে রানি মুখোপাধ্যায় কমল হাসনের চুমুর দৃশ্য সুপারহিট হয়েছিল।
২০০৬ সালের 'ধুম ২' ছবিতে একটি অতি অন্তরঙ্গ চুমুর দৃশ্যে অভিনয় করেছিলেন হৃতিক রোশন ও ঐশ্বর্য রাই। দৃশ্যটি নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। ইন্ডাস্ট্রিতে কানাঘুসো শোনা যায়, বচ্চন পরিবার থেকেই দৃশ্যটি নিয়ে কড়া আপত্তি জানানো হয়েছিল।
পরিচালক হিসেবে যশ চোপড়ার শেষ ছবি 'যব তক হ্যায় জান'-এর একটি দৃশ্যে ছবিতে চুমুর দৃশ্যে অভিনয় করেছিলেন শাহরুখ খান ও ক্যাটরিনা কাইফ। এই দৃশ্যটি অভিনেতা শাহরুখের কেরিয়ারের প্রথম অনস্ক্রিন চুমু।
২০১৩ সালে মুক্তি পাওয়া 'গোলিয়োঁ কি রাসলীলা রামলীলা' ছবিতে চুমুর দৃশ্যে অভিনয় করেন দীপিকা-রণবীর। আজ থেকে এক দশক আগের ভারতে সেই দৃশ্য কার্যত ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল।
যদি চুমু দিলে না প্রাণে:
'অরুন্ধতি, সর্বস্ব আমার
হাঁ করো, আ-আলজিভ চুমু খাও, শব্দ হোক ব্ৰহ্মাণ্ড পাতালে...' লিখেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। স্রেফ চুমুকে কেন্দ্র করে সাহিত্য-সিনেমা সহ শিল্পের নানাদিক রীতিমতো আলোকিত! এই চুমুর আবার নানা প্রকারভেদ রয়েছে। নানা ভঙ্গির ও নানা কিসিমের চুম্বন। জানেন ঠিক কত রকমের চুম্বন রয়েছে আসলে?
French Kiss: ঠোঁটে ঠোঁট রেখে অন্তরঙ্গ এবং আবেগঘন চুমু। এই সময়ে পরস্পরের জিভও ছুঁয়ে থাকে।
Single Lip Kiss: শুধুমাত্র একটি ঠোঁটে চুমু।
American Kiss: এখানে শুধুমাত্র পরস্পরের ঠোঁট ছুঁয়ে থাকে। জিভের স্পর্শ হবে না।
Lizzy Kiss: এক্ষেত্রে শুধু পরস্পরের জিভের স্পর্শ হবে।
Ice Kiss: দু’জনের ঠোঁটের মাঝে বরফ রেখে চুমু।
Nibble Kiss: সঙ্গীর নিচের ঠোঁটে চুমু খেয়ে সেখানে অল্প কামড় বসানো হল এই চুমুর বৈশিষ্ট্য।
Lip Trace Kiss: জিভ দিয়ে সঙ্গীর ঠোঁটে চুমু।
Lip Gloss Kiss: চুমুর সময়ে সঙ্গীর ঠোঁট এমনভাবে ভিজিয়ে দেওয়া যাতে মনে হয় তিনি লিপ-গ্লস ব্যবহার করেছেন।
Butterfly Kiss: চুমু খাওয়ার সময়ে পরস্পরের চোখের পাতা ছুঁয়ে থাকাকে বাটারফ্লাই কিস বলে।
Spiderman Kiss: পরস্পরের মাথা উলটো দিকে রেখে এই চুমু খাওয়া হয়।
Earlobe Kiss: সঙ্গীর কানে চুমু খাওয়া হল এর বৈশিষ্ট্য।
Air Kiss: এটি ঠিক প্রেমের চুম্বন নয় বরং এটি সৌজন্যমূলক চুম্বন। পরস্পরের গালে গাল ঠেকিয়ে বাতাসে চুমু ছুড়ে দেওয়ার রেওয়াজ।
Sugar Kiss: পরস্পরের ঠোঁটে চিনি মাখিয়ে চুমু খাওয়ার রীতি এই পদ্ধতিতে।
Drink Kiss: মুখে যে কোনও একটি পানীয় রাখা। তারপরে সেই পানীয় চুমু খাওয়ার সময়ে সঙ্গী মুখে ঢেলে দেওয়া।
Underwater Kiss: জলের নিচে স্নানরত অবস্থায় চুম্বন।
Vacuum Kiss: একেবারে হাঁ করে চুমু খাওয়া। এই সময়ে সঙ্গীর মুখের ভিতর থেকে বাতাস টেনে নেওয়ার চেষ্টা।
Eskimo Kiss: এসকিমোদের সংস্কৃতির অঙ্গ এটি। প্রকৃত চুমু নয়। পরস্পরের নাকে নাক ঠেকিয়ে ভালবাসা জানানো হল এর বৈশিষ্ট্য।
Candy Kiss: চুমুর সময়ে পরস্পরের পছন্দের ক্যান্ডি খাওয়া এবং তার পরে চুমু খাওয়া এর বৈশিষ্ট্য।
Jawline Kiss: পরস্পরের চোয়ালে চুমু খাওয়া হল এর বৈশিষ্ট্য।
Wet Kiss: সব চুমুর সম্মিলিত ফলও বলা যেতে পারে একে। খুব আবেগঘন হয়ে ভেজা চুমু একেই বলে।
কিসসা 'কিস'-মত কা:
গবেষণা বলছে, চুম্বনের জেরে শরীরী থেকে অতিরিক্ত মেদ ঝরে যায়। অর্থাৎ, প্রতিদিন শরীরচর্চার মতোই রোজ যদি চুম্বন করেন. তাহলে ক্যালোরি দ্রুত কমতে শুরু করে। গবেষণায় জানা গিয়েছে, শুধু মনের মানুষ নয়, কাছের মানুষ বা সন্তানকে চুম্বন করলেও শরীরের অতিরিক্ত ক্যালোরি হ্রাস পেতে থাকে। জানা গিয়েছে, প্রতিদিন ১ মিনিট করে চুমু খেলে প্রায় ৫ ক্যালোরি পর্যন্ত ওজন কমতে পারে। ভালবাসার মানুষের কাছে চুম্বনের অনুভূতি সম্পর্কের বাঁধনকে আরও মজবুত গড়তে সাহায্য করে। শারীরিক নয়, মানসিক দিক থেকেও একে অপরের জন্য চুম্বন একেবারে ম্যাজিকের মতো কাজ করে। চুমুর মতো সুন্দর অনুভূতি শুধু শারীরিক চাহিদা মেটানোর অন্যতম অংশ হিসেবে প্রকাশিত হয় তা নয়, দেহের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি ও ক্যালোরি বার্ন করাতেও সাহায্য করে। মানসিক সমস্যা, স্ট্রেস কমাতে উষ্ণ আলিঙ্গন বা চুম্বনের আদান-প্রদানের দরকার পড়ে।
যদি সঙ্গীকে এক মিনিটের জন্য চুম্বন করেন তবে আপনি ২৬-এর বেশি ক্যালোরি পর্যন্ত ঝরাতে পারেন। উল্লেখ্য, প্রতিদিন যদি এক মিনিট করে চুম্বন আদান-প্রদান করলে আয়ু বৃদ্ধি হয়। নিয়ম করে শরীরচর্চার পাশাপাশি রোজ চুমু খেলেও স্বাস্থ্য থাকবে ঝরঝরে। মনেও থাকবে আনন্দ। জীবনে আসবে উদ্যম। প্রতিটি ১০-সেকেন্ড-দীর্ঘ ফ্রেঞ্চ কিসিংয়ের জেরে ৮০ মিলিয়ন ব্যাকটিরিয়ার আদান-প্রদান হয়। তবুও মুখগহ্বর পরিষ্কার করতে ও অতিরিক্ত লালা নিঃসরণ করতে চুম্বন করা প্রয়োজন। এই ধরনের কিসিংয়ের ফলে দাঁতের ক্ষয়ও কম হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে চুম্বনের কারণে মানসিক সমস্যাগুলি এক নিমেষে দূর হয় ও শরীর সুস্থ থাকে। গড়ে একজন ব্যক্তি চুম্বনে ৩৩৬ ঘন্টা ব্যয় করেন যা আমাদের জীবনের দু-সপ্তাহের সমান।
কুকুর সবচেয়ে চুম্বনযোগ্য পোষা প্রাণী। প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ তাঁদের পোষা প্রাণীকে চুম্বন করেন, তবে ৭০ শতাংশ কুকুর চুম্বন করার জন্য সেরা পোষা প্রাণী বলে জানাচ্ছে গবেষণা। ২১% মানুষ তাঁদের বিড়ালকে চুম্বন করে, সাত শতাংশ তাঁদের পাখি এবং দুই শতাংশ চুম্বনের সরীসৃপকে চুম্বন করেন।
১৯৬৬ সালে স্টার ট্রেকের সিরিজের একটি এপিসোডে প্রথমবারের জন্য টেলিভিশনের পর্দায় ঘনিষ্ঠ চুম্বন দেখানো হয়েছিল।
চুমুর ফাঁদ পাতা ভুবনে:
গবেষণায় আরও জানা গিয়েছে যে, চুম্বনরত অবস্থায় মস্তিষ্কে কর্টিসল হরমোনের ক্ষরণ কমে যায়। পরিবর্তে ওই সময় অক্সিটোসিন, সেরাটোনিন, ডোপামিন হরমোনের বাড়ে। এই হরমোনগুলি মন, শরীর এবং মেজাজ ভাল রাখতে সাহায্য করে। তাই চুমু খাওয়ার সময় প্রগাঢ় শান্তিতে বুজে আসে চোখ। চুমু খেলে মন শান্ত হয়, মানসিক চাপ কমে।
চুম্বনরত অবস্থায় রক্তনালিগুলির মুখ প্রসারিত হয়, শরীরে রক্ত সঞ্চালনের হার বেড়ে যায়। ঋতুস্রাবকালীন যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতেও চুমু দারুণ উপকারী। চুম্বনের সময় মুখের পেশিগুলি বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। বা়ড়তি মেদ ঝরিয়ে ত্বক টানটান রাখতে ব্যায়ামের বিকল্প হতেই পারে চুম্বন, এমনটাও বলেন বিশেষজ্ঞরা। চুম্বনের সময় হৃদ্স্পন্দন বৃদ্ধি পায়। শিরা, ধমনীগুলি প্রসারিত হয়। শরীরে রক্ত স্বাভাবিক ও স্বচ্ছন্দগতিতে প্রবাহিত পারে। এর ফলে রক্তচাপও নিয়ন্ত্রণে থাকে। চুমু খেলে ত্বকের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়। রক্ত সঞ্চালন সচল থাকার ফলে ত্বকে কোলাজেন উৎপাদন বাড়ে। কোলাজেন ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে। ত্বক মসৃণ রাখে। ত্বকের সতেজতা বজায় রাখে।
চুমু যে কোনও মানুষের জীবনেই আনে নতুন বসন্ত। চিরবসন্ত! বিশেষ করে প্রিয় মানুষের সঙ্গে ভালবাসার মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় চুমু খাওয়ার আনন্দের কোনও বিকল্পই নেই। সেই আনন্দধারা নিয়েই চুমুর আবেশ বয়ে চলেছে ভুবনে! যে আবেশে এক হয়ে যায় রাজা থেকে ফকির! মিলে যায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য। জীবনের নানা রঙের বাঁকে এক হয়ে থাকে ঠোঁটে ঠোঁট! আর তারপর? সে এক নতুন ও আনোখা রূপকথার দেশ!