‘তখন তো আর শোষণ বাঁধন মানব না
সবার এ দেশ সবার ছাড়া তো জানব না’....
হালফিলের রাজনীতিতে বাম শব্দের সঙ্গেই জোর করে সেঁটে দেওয়া হয় ৩৪ বছরের একটা সময়কাল। কিন্তু বামপন্থা মানেই তো কেবল একটা দল, বা দলের শাসনকাল নয়। দেশ তথা বিশ্বের নিরিখে এই শব্দের ধারণ ক্ষমতা যে সীমাহীন। আদর্শ , মনোন, যাপন, লড়াই পেরিয়েও এক বৃহৎ এক ইতিহাসের নাম বামপন্থা। লাল পতাকা মানেই সিপিএম, আজও বাংলার অসংখ্য মানুষের মধ্যে এই ধারণা গেঁথে রয়েছে। কিন্তু এর বাইরেও বামপন্থার এক সুবিশাল মুক্ত আকাশ রয়েছে। যেই আকাশে ডানা মেলেছিলেন প্রগতিশীল ভাবধারার অসংখ্য শিল্পীরা। আজ আলোতে বাম ভাবধারার সেই শিল্পীরাই, যাঁদের কলম, গান, নাটক থেকে শুরু করে পরিচালনা গান সবই বাম মুক্তচিন্তার দলিল হয়ে রয়ে গিয়েছে, এবং এযুগের এক গুচ্ছ শিল্পীও সেই বহমানতার শরিক হয়ে উঠেছেন।
হিংসা হানাহানি, শোষণ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠতে শুরু করল গান, কবিতা, নাটক। সালটা ১৯৪৩। বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে তৈরি হল একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক সংগঠন। প্রগতিশীল লেখক-শিল্পী গোষ্ঠী লাল পতাকার তলায় এসে জড়ো হলেন। জন্ম নিল ভারতীয় গণনাট্য সংঘ (Indian Peoples’ Theatre Association, সংক্ষেপে I.P.T.A।
সেই থেকেই বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনে একটু একটু করে জায়গা করে নিতে শুরু করল, গান ,কবিতা, নাটক, সিনেমা, স্লোগান, প্রবন্ধ। সংস্কৃতিকে সমাজ-বদলের হাতিয়ার হিসেবে হাল ধরলেন শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, চিত্তপ্রসাদ, দেবব্রত বিশ্বাস, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ঋত্বিক ঘটক, সলিল চৌধুরী, উৎপল দত্তের মতো ব্যক্তিত্বরা।
মিছিলের সুরের সঙ্গে মিশে যেতে থাকল সলিল চৌধুরীর লেখা একের পর এক গণ সঙ্গীত। সংগঠন তৈরির বছর দুইয়ের মাথায় ১৯৪৫ সালে, বিদ্যাধরীর বন্যায় ভেসে গেল অসংখ্য চাষের জমি। চাষীদের পেটে ভাত নেই, দুর্যোগে ভেসে গিয়েছে ঘর। তখনই সলিলের গান তোলে তুফান। ‘দেশ ভেসেছে বানের জলে’, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপে’, ‘ঢেউ উঠছে কারা টুটছে’- সলিলের কথায় এমন অসংখ্য গান তখন সাহস জোটালো বাংলার খেঁটে খাওয়া মানুষদের বুকে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, দেবব্রত বিশ্বাসরা তখন একের পর এক গান গাইছেন, যা স্লোগান হয়ে বিঁধছে তৎকালীন মানুষের বুকে।
গণনাট্য আন্দোলন ছিল মূলত রাজনৈতিক আদর্শের প্রতিফলন, মার্ক্সবাদ থেকে প্রণীত এক ধারা নাটকের মঞ্চে, সেই রূঢ় বাস্তব ফুটিয়ে তুলতে শুরু করলেন উৎপল দত্ত, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, শম্ভু মিত্ররা, বিজ্ঞ ভট্টাচার্য , তুলসী লাহিড়ীর । শাসকের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসির বিরুদ্ধে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে আইপিটিএ-র কুশীলবরা অভিনয় করতে শুরু করলেন নানা পথনাটিকা। তুলসি লাহিড়ির 'ছেঁড়া তার' বা বিজন ভট্টাচার্যের 'দেবীগর্জন' , কিংবা উৎপল দত্তের ‘তিতুমীর’, তৎকালীন নাট্যকাররা তখন লিখে চলেছেন একের পর এক ফ্যাসিবাদ বিরোধি নাটক। আমজনতার হৃৎস্পন্দনকে স্পর্শ করার জন্য নাটকে রাখা হল লোকসঙ্গীত। ইতালি, জার্মানি, স্পেন, গ্রিস প্রভৃতি দেশে শুরু হয় একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সাম্রাজ্যবাদ, ধীরে ধীরে তার প্রভাবে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে থাকে গোটা বাংলা।
সিনেমায় চলমান আন্দোলনের হাল ধরলেন মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকরা। নাগরিক জীবনে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, অর্থাভাব, শোষণের বিরুদ্ধে ক্যামেরায় চোখ রেখে গর্জে উঠলেন সেই যুগের পরিচালকরা। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ , ‘পুনশ্চ’ , ‘আকাশ কুসুম’, ‘কলকাতা ৭১’ , ‘পদাতিক’ সহ একাধিক সিনেমায় মৃণাল ফাটালেন নাগরিক জীবনের ভাঙাগড়া, হেরে যাওয়া, দাঁড়ানো থেকে প্রেম সবটা। নাগরিক, অযান্ত্রিক (১৯৫৮), বাড়ী থেকে পালিয়ে , মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার - এমন একাধিক ছবিতে ঋত্বিক বোঝালেন কেবল ‘সস্তার বিনোদন’ দেওয়া তাঁর সিনেমার কাজ নয়।
এরপর ৩৪ বছরের বাম শাসন দেখেছে বাংলা। বদল এসেছে গানে, ছবিতে, নাটক, কবিতায়। হেমাঙ্গ সলিলদের গানের ভাষা বদলিয়ে সম্প্রতি, রাজ্যের বাম দল গান বেঁধেছে ‘টুম্পা সোনা’র আধারেও। বদলেছে শৈলী, উপস্থাপনা।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজেকে বামপন্থী হিসেবে পরিচয় দিয়ে গিয়েছিলেন প্রয়াত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সব্যসাচী চক্রবর্তী, চন্দন সেন, মানসী সিনহা, শ্রীলেখা মিত্র, দেবদূত ঘোষ, বাদশা মৈত্র, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়রা বাংলায় পরিবর্তনের পরেও ভরসা রেখেছেন বাম আদর্শেই। লোকসভার আবহে তাঁদের কাউকে কাউকে ‘তারকা প্রচারক’ হিসেবে দেখা যাচ্ছে বাম প্রার্থীদের সমর্থনে। পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় , অনিক দত্ত সংগীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্র থেকে শুরু করে এযুগের নাট্যকার সৌরভ পালোধি, গায়ক অর্ক মুখোপাধ্যায়, দেবদীপ মুখোপাধ্যায়রাও সরাসরি পথে নেমেছেন বামেদের হয়ে। প্রয়াত সিপিএম নেতা শ্যামল কন্যা উষশী চক্রবর্তীও কখনও সৃজন, কখনও বা সুজন চক্রবর্তীর হয়ে প্রচারে নেমেছেন।
৩৪ বছর শেষে বাম জামানার পতন দেখেছে বাংলা। সংসদীয় লড়াই-য়ে ‘বাম’ শব্দের পাশে জুড়েছে ‘শূন্য’ শব্দটি। কোথাও গিয়ে চর্চা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, নাটকেও ধীরে ধীরে ভাটা পড়েছে। আর নতুন করে তৈরি হয়নি বাম সংস্কৃতির নতুন কোনও দলিল। এখনও তাই সলিল, হেমাঙ্গ, উৎপল, শম্ভুদের থেকেই ধার নিতে হয় গান কথা কবিতার লাইন। তবুও চেষ্টা জারি রেখেছেন একাংশের শিল্পীরা। ‘তারকাখচিত’ শাসক দলের উল্টোদিকে একটু একটু করে একজোট হয়েছেন এযুগের তুলনায় ‘প্রচারবিমুখ’ বাম মনস্ক শিল্পীরা। বদলেছে সময়, বাংলায় ধীরে ধীরে সংকটে পড়েছে বামেদের লড়াই আন্দোলন। তবে লাল পতাকার তলা থেকে সরে যাননি, এমন শিল্পীও বাংলার বুকে আজও রয়েছেন।