কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। এই তো, বছর তিনেক আগেও এই দুই শব্দবন্ধের ব্যঞ্জনা তেমন ছিল না সাধারণ মানুষের কাছে। তবে, এখন মানুষ জেনে গিয়েছে, পৃথিবীর সব আশ্চর্য কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গোটা পৃথিবীর রিমোট কন্ট্রোল হতে শুরু করেছে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স। মানুষের বুদ্ধিমত্তা সেখানে কোথায় লাগে। আর শুধু বুদ্ধিমত্তাই বা বলি কীভাবে, সৃজনশীলতাতেও মানুষকে, বিশ্বের তাবড় তাবড় কবিকে, শিল্পীকে, সাহিত্যিককে ছাপিয়ে যাচ্ছে এআই।
আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে;
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;
কিম্বা to be or not to be that is the question, বাংলা, বা বিশ্ব কবিতার বিখ্যাত বিখ্যাত লাইন। কিন্তু এই প্রজন্মের নাকি এসব মনে ধরছে না। বরং ভাল লাগছে চ্যাটজিপিটি-র কবিতা। একসময় বাংলা সাহিত্যে, বলা হতো পুজো সংখ্যা বা ফরমায়েসি কবিতা-গল্পে সাহিত্যের মান পড়ছে ক্রমাগত। কিন্তু, এআই তো মানুষ নয়, ডেডলাইনের চাপ নিতে গিয়ে লেখনি খারাপ হয় না, ক্লান্তিতে কলম চলছে না, তেমনও হয়না। যখন যেমন বরাত আসছে, তেমন তেমন লিখে ফেলছে এআই। পাঠকের কত বাধ্য। এ হেন মনের মতো এই কবি থাকতে আর কাউকে সেরা মনে হবে কেন? সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা বলছে, শেক্সপিয়র, বায়রন, ইলিয়টের মতো সর্বকালের সেরা কবিদের লেখাকে, জনপ্রিয়তায় ক্রমশ হার মানাচ্ছে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কবিতা। প্রয়োজনীয় কম্যান্ড পাওয়ার পর নিমেষের মধ্যে এআই পাঠকের কাছে এনে দিচ্ছে তাঁর মনপসন্দ কবিতা। এমন পেশাদারিত্ব দেখাতে পারেনি দুনিয়ার কোনও কবি-সাহিত্যিক।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) নতুন নতুন কামাল চমকে দিচ্ছে রক্তমাংসের মানুষকে৷ এর আর্শীবাদ যেমন আছে, তেমন আছে অভিশাপও৷ বহু সংস্থায় কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে। কারণ মানুষের কাজ অনেক কম সময়ে করে দিচ্ছে এআই৷ এবার এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে একজন আস্ত মডেল তৈরি করে ফেলেছেন বিজ্ঞানীরা। তার নাম আইতানা লোপেজ৷ সে স্পেনের প্রথম এআই মডেল। আইতানার কার্যকলাপ রীতিমতো চোখ কপালে তোলার মতোই।
আইতানা যে রক্তমাংসের মানুষ নয়, তাকে দেখে বা কথা বলে তা বোঝে, কার সাধ্য? মাথাভর্তি ঘন ঢেউখেলানো গোলাপি রঙের সিল্কি চুল। ঠিক যেন বার্বি ডল। টিকালো নাক, চোখের ওপর ট্রিম করা সরু ভুরু, এককথায় অপরূপা সুন্দরী।
মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া এই এআই কন্যের রোজগারও চোখ কপালে তোলার মতো। মাসে তার আয় দশ হাজার ইউরো। ভারতীয় মুদ্রায় যা ন’লক্ষ টাকা। এই টাকা পুরোটাই যাচ্ছে আইতানার স্রষ্টাদের পকেটে।
সোস্যাল মিডিয়ায় আইতানার অনুরাগীর সংখ্যা ১২ কোটির বেশি। সে মূলত তিনটি কাজ করে। মাদ্রিদে সপ্তাহান্তে ছুটি কাটানোর জন্য বিভিন্ন আকর্ষণীয় জায়গার সুলুকসন্ধান দেয়, আকর্ষণীয় গেমিং সেশনের খোঁজ দেয় এবং পশ্চিম এবং প্রাচ্যের সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটায়।
কীভাবে আইতানাকে তৈরি করার কথা মাথায় এল স্রষ্টাদের? কারণ, এক সময় বার্সিলোনায় কিছু কারণে এত খারাপ সময় যাচ্ছিল, বিজ্ঞাপনের জন্য পয়সা দিয়েও মডেল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তাঁদের একেক জনের একেক সমস্যা, কারোর পারিশ্রমিক মনের মতো হচ্ছে না, কারোর সংশ্লিষ্ট ব্র্যান্ডের মুখ হতে সমস্যা, এরকম আরও অনেক। এই সমস্যার মুখে পড়ে একটি নতুন উপায় বার করা হল। রক্ত মাংসের মডেল না হয়ে যদি হয় আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে বানানো মডেল? সেই ভাবনা থেকেই আইতানার জন্ম। এখন স্পেনের কত কত ব্র্যান্ডের মুখ আইতানা!
তবে সমস্যা একটা আছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি রোবটকে কেন ফলো করবে মানুষ? রোবট না পারে চিন্তা করতে, না আছে বুদ্ধি, না আছে সৃজনশীলতা, তাহলে আছেটা কী? মানুষ গল্প শুনতে ভালবাসে, তাই ইন্সটাগ্রামে আইতানার ছবি দেওয়া হয় নানা মেজাজে, নানা সাজে। বেশ খানিকটা 'মানবিক' করে তুলতে, একঘেয়েমি কাটাতে লুক বদলও হয় আইতানার।
আইতানার দুর্দান্ত সাফল্য দেখে পরবর্তী মডেল তৈরির পরিকল্পনা শুরু হয়েছে। তার নাম হবে মাইয়া। আইতানার তুলনায় সে হবে খানিকটা লাজুক। তার মাধ্যমে আরও বেশি উপার্জন করবেন বলে আশা করছেন স্রষ্টারা।
চলতি বছরের জুনে, না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন ৮৭ বছরের মেরিন স্মিথ (Marine Smith)। মেরিনের শোকসভায় এসে তো আত্মীয় পরিজনরা হতবাক। সকলের সঙ্গে কথা বললেন মৃতা। জীবন এবং আধ্যাত্মিকতা নিয়ে কথা বললেন শোকসভায় উপস্থিত সকলের সঙ্গে। নটিংহামের ব্যাবওয়ার্থের ঘটনা।
‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)’ (Artificial Intelligence)-এর মাধ্যমে ‘হলোগ্রাফিক’ ভিডিও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এই ভাবে অবাস্তবকে বাস্তব করে দেখিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
মেরিন স্মিথের স্মরণসভায় যোগ দিতে এসে প্রথমটায় বেশ ঘাবড়েই যান আত্মীয়-পরিজনেরা। তাঁরা দেখেন সামনের পর্দায় তাঁদের সঙ্গে কথা বলছেন মেরিনা। একটু ধাতস্থ হওয়ার পর পরিবারের সদস্যরা নানা প্রশ্নও করেন, যার উত্তর দেন মেরিনার ‘হলোগ্রাফিক’ অবয়ব।
মজার ব্যাপার হল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে এই যে প্রযুক্তিটি তৈরি হয়েছে, মেরিনের ছেলে স্টিফেন স্মিথই এর উদ্ভাবক। ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্যে এই প্রযুক্তিটি জনসাধারণের হাতের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। স্টিফেন লস অ্যাঞ্জেলস-ভিত্তিক এআই সংস্থা স্টোরিফাইলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও।
ক্রমশ উন্নত হচ্ছে এআই প্রযুক্তি। সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, মানুষের ভাবনাকেও পড়ে ফেলতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। টেক্সটের আকারে লিখেও ফেলতে পারে তা। ননইনভেসিভ পদ্ধতিতে (মস্তিস্কে কোন চিপ বসানো ছাড়াই) মানুষের ভাবনাকে লিখতে পারে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স। গবেষকরা পদ্ধতিটির নাম দিয়েছেন সিমেনটিক ডিকোডার। গবেষকরা প্রাথমিক ভাবে মনে করছেন, স্ট্রোক ও প্যারালাইসিসে যেসব রোগী কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছেন তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়াবে প্রযুক্তিটি।
মাইক্রোসফটের চ্যাটজিপিটি, গুগুলের বার্ড ব্যবহার করে গবেষণাটি করেছেন ‘ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস অ্যাট অস্টিনে’র একদল গবেষক। নেচার নিউরোসায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত ওই গবেষণাপত্রে।
কোনো গল্প শোনার পর বা কোন কিছু কল্পনা করার পর মানুষের মনে যেসব ভাবনা মনে খেলা করে, তার প্রায় ৫০ % লিখে ফেলতে পেরেছে এই এআই প্রযুক্তিটি। এআই এক অপার বিস্ময়ের নাম।