মধ্যরাত। আলো-আঁধারির অলিগলি। হেঁটে যাচ্ছেন একজন মানুষ। ছাপোষা, সাধারণ মানুষ। নিজের বাড়ি ফিরছেন তিনি। রাস্তায় যতদূর চোখ যায়, কেউ নেই। ফাঁকা রাস্তায় নিজের মনে হাঁটতে হাঁটতে তিনি খেয়ালও করেননি, তাঁর পিছনে একেবারে নিঃশব্দে ভয়ানক শ্বাপদের মতো ঠান্ডা মাথায় এসে দাঁড়িয়েছে আরও একজন। যে বেশ খানিকক্ষণ ধরেই ওই মানুষটির পিছনে পিছনে এসেছে। অথচ, তিনি কিছু বুঝতেই পারেননি। কিছু একটা বিপদের আঁচ করে ধীরে ধীরে পিছনে ঘুরলেন এতক্ষণ একমনে হাঁটতে থাকা সেই মানুষটি। সঙ্গে সঙ্গেই চাপা আওয়াজ। মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল একটা মৃত্যু। একটা হত্যা। সাক্ষী থাকল শুধু ওই ফাঁকা রাস্তার কয়েকটা লাইটপোস্ট। হত্যাকারী যেমন নিঃশব্দে এসেছিল, তেমন নিঃশব্দেই চলে গেল আবার!
সিরিয়াল কিলার (Serial Killer)!
শুনলেই গা-ছমছম করে ওঠে। মনে হয়, পরের টার্গেট আমি নিজেই নই তো? যুগের পর যুগ ধরে পৃথিবীর বহু ভাষায় এই সিরিয়াল কিলারদের নিয়ে রচনা করা হয়েছে হাড়হিম করা সব ক্রাইম থ্রিলার (Crime Thriller)। তৈরি হয়েছে দুরন্ত সব সিনেমাও। হলিউডের 'সেভেন' থেকে বলিউডের 'কৌন', দক্ষিণ ভারতের 'রাতসাসান' বা 'অঞ্জাম পাথিরা' থেকে টলিউডের 'বাইশে শ্রাবণ'- তালিকা আসলে শেষই হওয়ার নয়। তবে সিরিয়াল কিলারদের অস্তিত্ব শুধু কল্পনাতেই সীমাবদ্ধ নয়। বাস্তবেও এমন এমন সিরিয়াল কিলারের নাম উঠে এসেছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের পুলিশ-প্রশাসনের ডায়েরিতে, যাদের 'কর্মকাণ্ড'-র কথা শুনলে শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যেতে বাধ্য।
এই তালিকায় ভারতের রামন রাঘব, অটো শঙ্কর, সায়ানাইড মল্লিকা, রেনুকা শিন্ডে (যাকে ভারতের প্রথম মহিলা সিরিয়াল কিলারও বলা হয়ে থাকে) যেমন রয়েছে। তেমনই রয়েছে বিদেশের টেড বানডি, হ্যারল্ড শিপম্যান, জন ওয়েন গেসি, এইচ এইচ হোমসের মতো সিরিয়াল কিলাররাও। আর, 'সিরিয়াল কিলার' (Serial Killer Crime) বলতে বাঙালির যার কথা প্রথম মনে আসে, সেই 'স্টোনম্যান'-ও রয়েছে এই তালিকায়। কে ছিল সেই 'স্টোনম্যান'-এর নেপথ্যে, সেই রহস্যের সমাধান হয়নি আর কোনওদিন।
এবার জেনে নেওয়া যাক, একজন মানুষকে 'সিরিয়াল কিলার' (Facts about Serial Killers) কখন বলা হবে? বিশেষজ্ঞ এবং গবেষকদের মতে, কমপক্ষে এক মাসের বেশি সময়ে ন্যূনতম তিনজনকে হত্যা করেছে একই ব্যক্তি, এক হত্যার সঙ্গে পরের হত্যার কয়েকদিনের ব্যবধান রেখে- এমন হত্যাকারীকেই বলা হবে 'সিরিয়াল কিলার'।
আসলে, সিরিয়াল কিলারদের নিয়ে উৎসাহের একটা মূল কারণ হল- এরা বেশিরভাগই পুলিশ বা গোয়েন্দাদের কাছে চিরকালের মতো 'অধরা'-ই থেকে যায়। এই বিশেষ ধরনের খুনীদের 'কার্যকলাপ' ভাল করে বিশ্লেষণ করলে সবার আগে যে শব্দটি স্পষ্টভাবে উঠে আসে, তা হল- 'প্যাটার্ন'। দুনিয়ার প্রায় সমস্ত সিরিয়াল কিলারই একটা বিশেষ প্যাটার্ন অনুসরণ করে। কেউ শুধুমাত্র বিবাহিত নারীদের হত্যা করে বিষ দিয়ে, কেউ বা হত্যা করে ফুটপাথে শুয়ে থাকা ঘরহীন মানুষদের। কেউ হত্যা করে স্কুলপড়ুয়াদের, কেউ বা টার্গেট করে মডেলদের। কারও নিশানায় আবার শুধুমাত্র দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষরা। হাজারো প্যাটার্ন, তার হাজারো দিক। তালিকার কোনও শেষ নেই। কিন্তু, তদন্ত করতে গেলে প্রথমেই এই প্যাটার্নটাকে ভাল করে বুঝতে হবে। তারপর সেই প্যাটার্নকে অনুসরণ করে একটি একটি করে ধাপ মিলিয়ে মিলিয়ে এগোনো- অভিজ্ঞ পুলিশ আধিকারিক এবং গোয়েন্দাদের মতে, সিরিয়াল কিলারদের ধরতে পারার এটিই অন্যতম গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। তবে, তার সঙ্গে এ কথাও মনে রাখা জরুরি যে, শুধুমাত্র এই পদ্ধতিকেই অন্ধের মতো অনুসরণ করলে তদন্তের মাঝপথেই মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ তো গেল অপরাধী পাকড়াও করার গল্প। কিন্তু, সবথেকে বড় প্রশ্ন হল, একজন সাধারণ মানুষ 'সিরিয়াল কিলার' হয়ে ওঠে কী কারণে? এমন কী কী কারণ রয়েছে, যার জন্য একেবারের ছাপোষা নির্বিবাদী দেখতে মানুষও (অনেক সিরিয়াল কিলারকেই গ্রেফতারের পর অবাক হয়ে গিয়েছেন গোয়েন্দারাও। দেখা গিয়েছে, অতীতে সামান্য ঝামেলা করার রেকর্ডও নেই যার, তেমন মানুষই হয়তো করে চলেছিল একের পর এক ভয়াবহ খুন! আর তার ফলেই তাকে ধরা মুশকিল হয়ে যায়।) একের পর এক খুন করে চলে ঠান্ডা মাথায়?
সব সাইকোপ্যাথ সিরিয়াল কিলার না হলেও সব সিরিয়াল কিলারই সাইকোপ্যাথ, এমনটাই বলে থাকেন মনোবিজ্ঞানীরা। এখনও পর্যন্ত যতজন সিরিয়াল কিলার ধরা পড়েছে, তাদের বয়ানে অনুতাপের বিন্দুমাত্র ছোঁয়া নেই বললেই চলে। অনুশোচনা তো দূরের কথা, বরং, জবানবন্দিতে স্পষ্ট টের পাওয়া যায়, তারা অপরাধ করে যথেষ্ট খুশিই।
সিরিয়াল কিলার নিয়ে পাশ্চাত্যের দুনিয়ায় বহু চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটলেও ভারতও এই বিষয়ে পিছিয়ে নেই খুব একটা। টাকার লোভ থেকে নিজের 'মানসিক শান্তি' থেকে শুরু করে অন্য খুনিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় একের পর এক খুন- কী নেই সেখানে!
মনঃস্তত্ত্ববিদদের মতে, এর নেপথ্যে নানা কারণ থাকতে পারে। একটা বড় কারণ হল, কোনও বিশেষ চাইল্ডহুড ট্রমা। এছাড়া, যৌন-হতাশা কিংবা চিরকাল সকলের কাছ থেকে নানা কারণে অপমানিত হতে হতে নিজের ভিতরে একটা বিশেষ 'সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স'-কে জাগিয়ে তোলার তীব্র প্যাশন থেকেও সিরিয়াল কিলার হয়ে যেতে পারে কেউ। এমনকি, সমাজের 'ভাল করার লক্ষ্য' নিয়েও হত্যাকারী হয়ে যায় এদের মধ্যে অনেকে। অর্থাৎ, একের পর এক মানুষ মারার পরেও তাদের মনে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা থাকে না। কারণ, তাদের মতে, 'ওই মানুষগুলিকে হত্যা করে সমাজের ভাল করছে তারা'।
আদৌ কি ভাল হয় কারও? তা যে হয় না। সে কথা তো স্পষ্ট। তবে, তারপরেও তাদের নিয়ে উৎসাহ কমে না একটুও। যে কারণেই গল্প-উপন্যাস হোক কিংবা সিনেমা-সিরিজ, সিরিয়াল কিলারদের নিয়ে কাহিনি ফাঁদলে তার কোনও মার নেই! মূল কারণ আসলে ওই একটাই। তারা আমাদের পাশেই আছে। হয়তো আমাদের পাশের বাড়িরই কেউ বা হয়তো নিজেরই আত্মীয় বা বন্ধু। আমরা তাদের চিনি না। আমরা তাদের বুঝি না। বোঝার চেষ্টাই করি না। তারা 'অধরা'