আরজি কর হাসপাতালে ডিউটিরত চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা পার করল প্রায় একটা মাস। বিচারের দাবিতে বাংলাজুড়ে জ্বলে ওঠা আগুনকি এবার নিভু নিভু? মোটেও না, বরং আঁচ বাড়ছে। আট থেকে আশি, গ্রাম থেকে শহর, সব পেশার, সব এলাকার মানুষ প্রতিবাদের অংশ হয়ে উঠছে। ক্রমে গণ আন্দোলনের চেহারা নিচ্ছে আরজি করের ঘটনায় মানুষের প্রতিবাদ।
গত এক মাসে, একটা স্লোগান মানুষের মুখে মুখে...''বিচার যত পিছোবে, মিছিল ততোই এগোবে'। হচ্ছেও তাই, সময়ের সাথে সাথে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে প্রতিবাদ, জমায়েত। কোনও মিছিল স্লোগানে মুখরিত, কোনও মিছিলে সুরে সুরেই প্রতিবাদ। কোনওটা আবার মৌন মিছিল। কোথাও তুলির টানে প্রতিবাদ এঁকে রাখছেন শিল্পীরা।
কোথাও টলমল পায়ে শিশুরাও হেঁটে বেড়াচ্ছে মিছিলে, হাঁতে ঘুরছে 'ওই ওয়ান্ট জাস্টিস' পোস্টার। কোথাও বাবা-মায়েদের কোলে চেপে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা শিখে নিচ্ছে, রবিবার মানেই দুপুরে ভাতঘুম দেওয়া নিটোল ছুটির দিন নয়। আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, মিছিলের সময়েই জোর বৃষ্টি আসবে, তাতে কী? মিছিল ছোট হচ্ছে না। হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে গেলে ক্লান্ত একটা শরীরকে বাবা মায়েরা কোলে তুলে নিচ্ছেন, ক্লান্তি ফুরোলে আবার হাঁটা শুরু। স্কুল-টিউশন-হোম ওয়র্কের মাঝে কচিকাঁচারা নাকি বাড়িতে প্রায়শই খোঁজ নেয় বাবা মায়ের কাছে, দিদির খুনীরা শাস্তি পেল?
কোনও পাড়ার মোড়ে আবার রাত দখলের ভিড়ে দাঁড়িয়ে অশীতিপর বৃদ্ধ, পরিবারের সবাই বেরোতে বারণ করেছিল, কিন্তু ঘরে থাকতে পারেননি। হাতে ছোট্ট তিরঙ্গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সব স্লোগান বুঝতেও পারছেন না, খানিক যেন থম মেরে আছেন। কোথাও আবার নাকে রাইলস টিউবের নল নিয়েই মিছিলে চলে আসছেন কোনও বৃদ্ধ। হাঁপানির সমস্যা, এত ভিড়ে দম বন্ধ লাগে, তবু এসেছেন। কারণ সমাজের এই দম বন্ধ করা পরিস্থিতিতে ঘরে বসে থাকাটাই অনেকের কাছে বিলাসিতা।
এর আগে এমন গণ আন্দোলনের সাক্ষী থাকেনি কলকাতা। মিছিল-প্রতিবাদ আগেও হয়েছে, কিন্তু সমাজের সব স্তরের মানুষকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়নি কোনও একটা ঘটনা। সমাজ বিশ্লেষকদের অনেকের মত, আরজি করের ঘটনা আসলে শুধুই ধর্ষণ কিমবা খুনের ঘটনা নয়, একই সঙ্গে নারী নিরাপত্তা, প্রসাশনিক ব্যর্থতা, সরকারি হাসপাতালে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির বিষয়গুলি সামনে নিয়ে এসেছে। তাছাড়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় লিঙ্গসাম্য শব্দটা এখনও অভিধানেই রয়েছে। সাম্যের অধিকারের জন্য মেয়েদের এবং প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের লড়াইয়ের পথ এখনও মসৃণ নয়। মহিলা এবং এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের মানুষকে এখনও যৌন হেনস্থার শিকার হতে হয় প্রায় নিয়মিত। কোনও ঘটনা সামনে আসে, কোনওটা চাপা পড়ে যায়। এ সব কত চাপা পড়ে যাওয়া ঘটনায় তৈরি হওয়া ক্ষত থেকেই তিলোত্তমার আওয়াজ হয়ে উঠছেন মিছিলে আসা মানুষেরা। তাঁদের চিৎকারে বেরিয়ে আসছে কত বছরের জমিয়ে রাখা কান্না, যন্ত্রণা। তাই এই প্রতিবাদ সংগঠিতর চেয়ে অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ত।
হাজার হাজার মানুষ পথে নামছেন, স্লোগান লিখছেন, পথে নেমে পথ চিনছেন, হাতে হাত রাখছেন। কত মুহূর্তের জন্ম হচ্ছে। মিছিলের পরিচিতি কোথাও বদলে যাচ্ছে বন্ধুত্বে। মিছিল শেষে সবাই ঠিক মতো পৌঁছলেন তো, খোঁজ নেওয়া চলছে হোয়াটসআপ গ্রুপে। এক মিছিল থেকে অন্য মিছিলে মানুষ শুধরে নিচ্ছেন নিজেদের ভুল। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে গিয়ে কারোর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, ছুটে গিয়ে জল নিয়ে আসছেন যিনি, তার সঙ্গে হয়তো সেই মিছিলেই প্রথমবার দেখা। কেউ গরমে অসুস্থ বোধ করছেন, অমনি হাত পাখা এগিয়ে দিচ্ছেন আগের মিছিলে সই পাতানো নাম না জানা কেউ। এ এক অন্য যাপন। তিলোত্তমা যেন এই অসময়েও গোটা বাংলাকে দেখিয়ে দিয়ে গেল, বেঁধে বেঁধে থাকা কাকে বলে।