স্মৃতি এক অমোঘ বস্তু! কত প্রাণীর জীবনের প্রায় গোটা অস্তিত্বটাকেই যে প্রায় পদ্মপাতায় জলের ভঙ্গিতে ধরে রাখে এই দু'অক্ষরের ছোট শব্দটি, তার ইয়ত্তা নেই। মানুষ তো বটেই, তার সঙ্গে এই তালিকায় জুড়ে যায় অক্টোপাস, ডলফিন, শিপাঞ্জি বা কুকুরের মতো প্রাণীদের নামও। কোন জায়গা ফেলে এল তারা, কাকে ছেড়ে এল, কে-ই বা তাদের ছেড়ে চলে গেল- ভোলে না তারা কিছুই। কিন্তু, প্রশ্ন হল, ঠিক কতদিনের জন্য? মস্তিষ্ক, স্মৃতি ও তার কার্যকারণের বিষয়টির পুরোটা জানতে এখনও বাকি বৈজ্ঞানিকদের। তাই, এর স্পষ্ট কোনও উত্তরও নেই তেমনভাবে। কেউ হয়তো ৫ দিন মনে রাখতে পারল কোনও ঘটনা। কেউ বড়জোর ৫ বছর। কিন্তু, জীবনের ঘটে যাওয়া অতি সূক্ষ্ম ও সামান্য ঘটনাও আমৃত্যু মনে রেখে দিতে পারে- এমন প্রায় অবিশ্বাস্য কাণ্ডটি একমাত্র হাতি ছাড়া আর কোনও প্রাণীর মধ্যেই দেখা যায় না চট করে। বিষয়টি এতটাই বহুধাবিস্তৃত যে, দুর্দান্ত স্মৃতিশক্তিকে বোঝাতে ইংরেজি ডিকশনারিতে একটি শব্দও রয়েছে- 'এলিফ্যান্ট'স মেমোরি'।
এই পৃথিবীতে মোট তিন প্রজাতির হাতি রয়েছে। আফ্রিকায় দু’টো আর ভারতের একটা। আফ্রিকান বুশ এলিফ্যান্ট, আফ্রিকান ফরেস্ট এলিফ্যান্ট এবং এশিয়ান এলিফ্যান্ট। ৩০ লক্ষ বছরেরও বেশি সময় আগে ভারতীয় হাতির প্রজাতিধারাটি অপর শাখা থেকে আলাদা হয়ে যায়।
শুধু স্মৃতিশক্তিই নয়। হাতির চিন্তা করার শক্তিও প্রখর। তারা পরিকল্পনা করে, বিভিন্ন রকমের বস্তু ব্যবহার করে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। বনে ঘুরতে গেলে হাতির দলের কাউকে না কাউকে গাছের ছোট ডাল ভেঙে ঝাড়নের মতো ব্যবহার করে গা থেকে মাছি তাড়াতে দেখা যাবে হামেশাই। হাতিরা বিদ্যুতায়িত বেড়ার উপর গাছের ডাল ইত্যাদি ফেলে তাকে অকেজো করে পেরিয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ তারা মনের মধ্যে ভবিষ্যতের ছবি গড়ে কর্মপদ্ধতি সাজাতে সক্ষম। অতীতও তারা সহজে ভোলে না। সেই অতীতের স্মৃতিতে কখনও কখনও আবার মিশে তাকে ভবিষ্যতে 'প্রতিশোধ' নেওয়ার বীজও।
শুধু প্রতিশোধের না, সুখের স্মৃতিও জোরালো হয়। অনেক সময় কোনও দল দু’ভাগ হয়ে দূরে চলে যায়। তারপর বহু বছর বাদে হঠাৎ দেখা হওয়ার পর একে অপরকে যেভাবে অভিবাদন জানায়, তা এক দেখার মতো দৃশ্য!
স্মৃতির তাড়না হাতিকে প্রতিশোধপ্রবণও করে তুলতে পারে। অসমের এক হাতির মালিক তাকে এক জনের কাছে রেখে দীর্ঘ দিনের জন্য চলে গিয়েছিল। অস্থায়ী পালকটি হাতিটিকে শারীরিক নির্যাতন করত। মালিক ফিরে আসতেই হাতিটি তার প্রতিশোধ নিল। পায়ের বাঁধন ছিঁড়ে প্রথমে হত্যা করে অস্থায়ী পালককে। তার পর মালিককে আজীবনের মতো পঙ্গু করে দিয়ে সে পালিয়ে যায়।
প্রতিশোধের উল্টো দিকে আছে হাতির সংবেদনশীলতা। তা কেবল নিজের প্রজাতির প্রতি নয়। আফ্রিকায় এক বার এক গোষ্ঠীজননী এক বনকর্মীকে হঠাৎ আক্রমণ করে। তাৎক্ষণিক ভুল বোঝাবুঝির পরিণাম। মানুষটির পা ভেঙে যায়। হাতিটি বুঝতে পারে, লোকটি চলচ্ছক্তিহীন। সে তাকে পাহারা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রায় দু’দিন পরে তাকে যখন খুঁজে পেল অনুসন্ধানকারী দল, হাতিটি তাদেরও এর কাছে ঘেঁষতে দিতে নারাজ। হাতিটিকে গুলি করে মারার উদ্যোগ হচ্ছে বুঝে আহত মানুষটিই ইঙ্গিতে নিষেধ করে। পরে কিছুটা কৌশলে ছাড়া পায় সে, শোনায় হাতিটি কী ভাবে সারাক্ষণ অন্য বন্য জন্তু থেকে তাকে রক্ষা করেছে।
একটি হাতির স্মৃতি তার বেঁচে থাকার চাবিকাঠি তো বটেই। তবে, শুধু তারই নয়। হাতির প্রখর স্মৃতির কারণে কখনও কখনও বেঁচে থাকতে পারে গোটা হাতির পালও। এই হাতির পালের একটি মাতৃতান্ত্রিক কাঠামো রয়েছে। যার নেতৃত্বে সাধারণত থাকে একটি বয়স্ক মহিলা হাতি। এই নেত্রী হাতিরাই বছরের পর বছর ধরে রীতিমতে স্মৃতিশক্তিকে ব্যবহার করে বেঁচে থাকার প্রশিক্ষণের একটি স্কুলই তৈরি করে ফেলে! যা সংশ্লিষ্ট পালের বাকি হাতিদের বন্য পরিবেশে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে।