ঘুম নিয়ে কার্যত জর্জরিত আধুনিক প্রজন্ম! নানা ধরনের স্ট্রেস, মোবাইল ফোন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় অত্যাধিক ব্যবহার ইত্যাদির ফলে দিনে চার-পাঁচ ঘণ্টার বেশি ভাল করে ঘুমই হয় না! পরিস্থিতি এমন যে, ঘুমের চিন্তাতেও ঘুম উড়ে যায়! এই ঘুম না থাকার ফলে শরীরে নানা সমস্যা হতে পারে। কিন্তু, জানেন কি, ঠিক এই কারণে, আপনার মস্তিষ্ক নিজেকে নিজেই খেয়ে ফেলতে পারে? চমকে যাচ্ছেন শুনে! চমকে যাওয়ার মতোই ব্যাপার! ভাবছেন, এ আবার কীভাবে সম্ভব? বিষয়টা একটু খোলসা করা যাক।
আমাদের মস্তিষ্কে অসংখ্য নিউরোন, সিন্যাপস এবং নিউরোনকে শক্তি জোগানো চার ধরনের গ্লিয়াল সেল বিদ্যমান।
শারীরবিদ্যার নীতি মেনেই, প্রতিদিন আমাদের দেহে লক্ষ লক্ষ কোষের মৃত্যু হয় এবং আবার লক্ষ লক্ষ কোষ তৈরিও হয়। প্রতিদিন এভাবেই আগেরদিনের শরীর পরেরদিন 'নতুন' হয়ে ওঠে! এই মৃত কোষ এবং কলা (টিস্যু)-কে বলা হয় ‘ডেবরিস’। অন্যদিকে, আমরা জানি আমাদের দেহে প্রতিদিন মেটাবলিজমে অসংখ্য বিক্রিয়া হয়। এই বিক্রিয়াগুলোর ফলে বিক্রিয়াজাত বেশ কিছু আবর্জনা তৈরি হয়। মানবদেহের মস্তিষ্কে তৈরি হওয়া এই আবর্জনাগুলিকে বলা হয় 'অ্যাডেনোসিন'। এবার, এই যে ডেবরিস এবং বিক্রিয়াজাত আবর্জনা মস্তিষ্কে তৈরি হয়, এগুলোও তো দূর করতে হবে!
এই কাজটাই করে অ্যাস্ট্রোসাইটিস নামের এক ধরনের বিশেষ গ্লিয়াল সেল। এদের কাজ মস্তিষ্ক থেকে ডেবরিস, আবর্জনা সব ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে মস্তিষ্ককে রিফ্রেশ করা বা বলা ভাল, নতুন করে কাজের জন্য প্রস্তুত করে তোলা। যে প্রক্রিয়ায় এই গোটা কাজটি সম্পন্ন হয়, তাকে বলে 'ফ্যাগোসাইটোসিস অব অ্যাস্ট্রোসাইট'। এই গোটা প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন হয় আমাদের ঘুমের সময়।
এই অ্যাস্ট্রোসাইট বেশি থাকলেই ক্ষতির পরিমাণ বাড়ে। এবার প্রশ্ন হল, অ্যাস্ট্রোসাইট বেশি থাকলে ক্ষতিটা কী? অ্যাস্ট্রোসাইট বেশি থাকলে বেশি ফ্যাগোসাইটোসিস হবে। ফলে সে অনেক বেশি সিন্যাপস (এক নিউরোনের সঙ্গে আরেক নিউরোনের সংযোগ) বাদ দিয়ে দেবে মস্তিষ্ক থেকে। মস্তিষ্কের নিজের অ্যাস্ট্রোসাইট কোষের মস্তিষ্কের সিন্যাপসকে খেয়ে ফেলাকেই বলা হয়- মস্তিষ্কের নিজেকে ভক্ষণ!
অর্থাৎ, মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা যুক্ত থাকে যে তন্তুর মাধ্যমে, সেগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ফলে আমরা ধীরে ধীরে অনেক কিছু ভুলে যাব! এটাকেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষা 'অ্যালঝেইমার' বলা হয়।
মস্তিষ্ক কখন নিজেই নিজেকে ভক্ষণ করা শুরু করে?
সাম্প্রতিক এক গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে যে, ঘুমের অভাব হলেই এই ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। মস্তিস্ক নিজেই নিজেকে খেয়ে ফেলে।
আমরা সবাই জানি- মস্তিস্ককে সক্রিয় রাখার জন্য ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। ঘুম হচ্ছে মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর দৈনন্দিন কর্মকান্ডের ফাঁকে বিশ্রাম নেওয়ার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আমাদের ঘুমের সময় সারা দিনে জমা হওয়া ক্ষতিকর পদার্থগুলো পরিষ্কার হয়। এতে মস্তিষ্ক আবার ঠিকভাবে কাজ করতে পারে ঘুম থেকে ওঠার পরে ।
মাইক্রোগ্লিয়া কোষ গুচ্ছ মস্তিস্ককে পরিষ্কার রাখার এই কাজটি করে, যারা স্নায়ুতন্ত্রের বর্জ্য, ক্লান্ত এবং মৃত কোষের বর্জ্য পরিষ্কার করে।
গবেষকদের মতে, অতিরিক্ত ঘুমের অভাব মাইক্রোগ্লিয়া কোষকে সক্রিয় করে এবং তাদের ফ্যাগোসাইটিক (কোষের বর্জ্য খেয়ে ফেলা) কাজে অনুপ্রেরণা দেয়, নিউরোইনফ্লামেশনের কোনও বড় লক্ষণ ছাড়াই। তার মানে হল, দীর্ঘ সময়ের ঘুমের অভাব মাইক্রোগ্লিয়াকে প্রভাবিত করে এবং অন্যান্য সমস্যার ব্যাপারে মস্তিষ্ককে সংবেদনশীল করে তোলে।
শরীরের সবচাইতে জটিল অঙ্গ মস্তিষ্ক। যা প্রতিনিয়তই নতুন করে নিজেকে তৈরি করছে, শক্তিশালী হচ্ছে আর নানা ধরনের ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এটা একটি অসীম প্রক্রিয়া, যেখানে কিছু কাঠামো ভাঙে আর কিছু কাঠামো একেবারে নতুন করে তৈরি হয়। এ নিয়ে আরও গবেষণা হলে বোঝা যাবে এই মাইক্রোগ্লিয়ার সক্রিয়তা মস্তিষ্কের ওপর আসলে কী প্রভাব ফেলে। তবে তা না জানা পর্যন্ত, যথেষ্ট পরিমাণে ঘুমানোটা নিজের জন্য এবং নিজের মস্তিষ্কের জন্যও নিরাপদ!