প্রেম, ভালবাসা...বলতে গেলে ছোট শব্দ । কিন্তু, তার পিছনে যে আবেগ, অনুভূতি তা ভাষায় প্রকাশ করার নয় । বুঝে নিতে হয় । ভালবাসা মানে যে দু'টি হৃদয়ের কানেকশন । যে মানুষটার জন্য পথের ধারে, পার্কে কিংবা কলেজের গেটের সামনে লাল গোলাপ হাতে দিনের পর দিন অপেক্ষা করা, বা শীতের সন্ধেয় গরম চায়ে চুমুক দিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা । অথবা মনের মানুষটির জন্য সারাদিন প্রজাপতি ধরে সারা শহরের বুকে রং ছড়িয়ে দেওয়া ! কিন্তু সেই রকম মানুষ খুঁজে পাওয়া কি এতই সহজ ? সবাই কি আর ভালবেসে থেকে যেতে পারে ? হাতে হাত রেখে বলতে পারে, আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী?
সত্যিই তো। কোথায় খুঁজবেন প্রিয়-জনকে? ডিসটেন্স লার্নিংয়ের যুগে কোচিং সেন্টার, কলেজে যাতায়াত কমছে Gen Z-র। ফলে বন্ধুত্বের হাতছানি কম। আবার কর্মক্ষেত্রেও শুরু হয়েছে Work From Home। ফলে অফিসের কাওকে যে প্রেম নিবেদন করবেন এমন সুযোগ কমছে ধীরে ধীরে। তাহলে উপায় কী? পথ এখন একটাই। অনলাইন ডেটিং অ্যাপ।
শুরুটা ১৯৬৫ সালে। হার্বার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র IBM 1401 কম্পিউটার নিয়ে কাজকর্ম শুরু করেন। লক্ষ্য ছিল একটাই। কম্পিউটার বেসড ম্যাচমেকিং শুরু করা। তবে সেটা শুধুমাত্র আমেরিকাতেই আবদ্ধ ছিল। যেমন ভাবা তেমন কাজও শুরু। দুই ছাত্র ৭৫টি প্রশ্নের একটি প্রশ্নমালা তৈরি করেন। বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্থানীয় এলাকায় যাঁরা সিঙ্গল ছিলেন তাঁদের কাছে সেই প্রশ্নমালা পাঠিয়ে প্রতিটি প্রশ্নের জবাব চাওয়া হয়েছিল। সেই প্রশ্নগুলির উত্তরের ভিত্তিতে পছন্দমতো মনের মানুষ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন হার্বার্ডের ওই দুই পড়ুয়া।
শুরু থেকেই অতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে পুরো পদ্ধতি। একবছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৬৬ সালে ৯০ হাজার সিঙ্গল, প্রেমিক-প্রেমিকা খোঁজার জন্য ওই কম্পিউটার বেসড ম্যাচ মেকিং পদ্ধতি ব্যবহার করতে শুরু করেন। বর্তমানে যা পরিচিত ডেটিং অ্যাপ নামেই।
তারপর কেটে গিয়েছে কয়েক দশক। শুধু মার্কিন সাম্রাজ্য নয়, গোটা বিশ্বের পাশাপাশি ভারতেও ব্যাপক ব্যবহৃত হতে শুরু হয় ডেটিং অ্যাপ। সম্প্রতি এক সমীক্ষা রিপোর্টে প্রকাশিত ২০২৩ সালে ৮ কোটিরও বেশি ভারতীয় ভালোবাসার মানুষ খুঁজতে ডেটিং অ্যাপ ব্যবহার করতেন। ২০২৪ এবং আগামী বছরগুলিতে সেই সংখ্যাটা লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পাবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ওই প্রতিবেদনেই প্রকাশ, স্মলকেস নামে একটি সংস্থা তাদের একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। যেখানে জানানো হয়েছিল, গোটা বিশ্বের মধ্যে পঞ্চম বৃহত্তম ডেটিং অ্যাপের বাজার রয়েছে ভারতে।
ভারতে এখনও পর্যন্ত ২০টির-ও বেশি ডেটিং অ্যাপ রয়েছে। স্ট্যাটিস্টার প্রকাশিত একটি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এই দেশে সবথেকে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে টিন্ডার। ডেটিং অ্যাপ ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ এই অ্যাপের ব্যবহারকারী। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে বাম্বল এবং বাদো।
এ-তো গেল কিছু তথ্য। কিন্তু শুধুই কি মনের মানুষের খোঁজেই ডেটিং অ্যাপের ব্যবহার বাড়ছে? পরিসংখ্যান কিন্তু সেরকম বলছে না। নিম্বল অ্যাপজেনি নামের একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত অনলাইন ডেটিং অ্যাপে যাঁদের মধ্যে পরিচয় হয় তাঁদের মধ্যে ৭০ শতাংশ ব্যবহারকারী বিশেষ এবং রোমান্টিক রিলেশনশিপ পর্যন্ত পৌঁছন। তবে ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে প্রতারণার ফাঁদও কম নয়।
সিভিকসায়েন্স ডট কম টিন্ডার ব্যবহারকারীদের নিয়ে একটি তথ্য প্রকাশ করেছে। ২০২৩ সালের হিসেবে টিন্ডার ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৩৫ শতাংশ ব্যবহারকারীর বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে, ২৫ শতাংশের বয়স ২৫ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে এবং ৩৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সীর সংখ্যা ২০ শতাংশ, ৪৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সীর সংখ্যা ৮ শতাংশ। অন্যদিকে টিন্ডার ব্যবহারকারীদের মধ্যে ২৪ শতাংশ মহিলা এবং ৭৫ শতাংশ পুরুষ।
অল্পবয়সীদের পাশাপাশি মধ্যবয়সীদেরও ভিড় বাড়ছে ডেটিং অ্যাপে। অনেকেই জানিয়েছেন, একাকিত্ব কাটাতেই ডেটিং অ্যাপের সাহায্য নিচ্ছেন মধ্যবয়সীরা।
আগে হালকা বা ক্যাজুয়াল সম্পর্কের জন্যই অনলাইন ডেটিং অ্যাপ ব্যবহার করা হত। অনেকের ধারণা ছিল সাময়িক প্রেম বা প্রতিশ্রুতিহীন সম্পর্ক খোঁজার জন্যই ডেটিং অ্যাপগুলি ব্যবহার করা হয়। সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানের Gen Z সত্যিকারের সম্পর্ক খুঁজতেই ব্যবহার করছেন ডেটিং অ্যাপগুলি। ভারতের ছোটো শহরগুলিতেও আগের চেয়ে বর্তমানে ডেটিং অ্যাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। এমনটাই দাবি ইন্টারনেট বিশেষজ্ঞদের। সম্প্রতি একাধিক বলিউড স্টারকেও দেখা গিয়েছে ডেটিং অ্যাপে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন হৃত্বিক রোশন, আদিত্য রায় কাপুর এবং অর্জুন কাপুর। এমনকি উর্বসী রাউতেলাও জানিয়েছেন তিনি ডেটিং অ্যাপ ব্যবহার করছেন।
ডেটিং অ্যাপের ব্যবহার বাড়ার ফলে প্রেম করার ধরনও বদল হয়েছে। জনপ্রিয়তা বেড়েছে লং ডিস্টেন্স রিলেশনশিপের। স্থান, কাল, ভাষার জড়তাও অনেক কমে গিয়েছে বলেই মনে করছেন ব্যবহারকারীরা।
বিশ্বাসে মেলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। চলিত এই প্রবাদবাক্য ধরে বলতেই হয় ডেটিং অ্যাপে প্রেম কতটা সফল বা বিফল হবে তা নির্ভর করে ব্যবহারকারীদের উপরেই। তবে সম্পর্কে যদি বিশ্বাস থাকে তাহলে একটা রাইট সোয়াইপেই মিলতে পারে আজীবন হাত ধরে চলার সঙ্গী।