'অব কি বার ট্রাম্প সরকার'...২০২০ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল ভোটের সময় এই স্লোগানই দিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী । কিন্তু, সেবার ডেমোক্রেটিক পার্টিকেই ভোট দিয়েছিলেন আমেরিকাবাসী । তবে, ২০২৪ সালের ভোটে হোয়াইট হাউস দখল করলেন ট্রাম্প । ট্রাম্পের জয় নিশ্চিত হতেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শুভেচ্ছা জানিয়েছেন । মোদী ও ট্রাম্পের সুসম্পর্কের কথা সকলেই জানেন । তার প্রমাণও বহুবার পেয়েছেন বিশ্ববাসী । এদিকে, ট্রাম্প জিততেই দুই দেশের সম্পর্ক আরও ভাল হবে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মহল । আরও একটা প্রশ্ন উঠছে ট্রাম্প ফের ক্ষমতায় বসায় ভারতের কি কোনও লাভ হবে ?
প্রশ্ন যখন উঠেছে, তার উত্তর খুঁজতে ফিরে যেতে হবে ১৯৭১ সালে । দিল্লিতে তখন ইন্দিরা গান্ধীর সরকার। বাংলাদেশে গণহত্যা চালাচ্ছে পাকিস্তান । পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে । শয়ে শয়ে শরণার্থীরা ভারতে আসতে শুরু করেন । সেইসময় ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করলেন পাকিস্তানকে যোগ্য জবাব দেবেন । যুদ্ধ ঘোষণা করলেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে । সেইসময় আমেরিকার তরফে ইন্দিরা গান্ধীকে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার বার্তা দিয়েছিল। পাকিস্তানকেই সমর্থন করেছিল আমেরিকা । কিন্তু, ইন্দিরা তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন । কূটনৈতিক সিদ্ধান্তে আমেরিকার হস্তক্ষেপ মেনে নেননি । ১৩ দিনের যুদ্ধে ভারতের কাছে হার স্বীকার করেছিল পাকিস্তান । ৭১-এর যুদ্ধের পর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল বাংলাদেশ । ইন্দিরা ঠিকই করে নিয়েছিলেন আমেরিকার দাদাগিরি সহ্য করবেন না ।
আমেরিকার প্রতি ইন্দিরার এই মনোভাব বজায় ছিল আমৃত্যু পর্যন্ত । এমনটাই দাবি করেন বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতারা । সেইকারণেই নিক্সন থেকে রেগান মার্কিন প্রেসিডেন্টের বদল হলেও ওয়াশিংটনের প্রতি দিল্লির ভাবনা ছিল খুব স্পষ্ট । যা ইন্দিরা পরবর্তী সময়ও অব্যাহত ছিল । সম্পর্কের বরফ গলে নয়ের দশকের গোড়ায় । প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় ভারতের জন্য পশ্চিমের দরজা হাট করেছিলেন পি ভি নরসিমা রাও । এই কাজ সম্ভব হয়েছিল তাঁর মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য ।
মূলত, ভারতের বাজারকে ব্যবহার করার জন্যই উদারিকরণের সিদ্ধান্তে সিলমোহর দিয়েছিল তৎকালীন কংগ্রেস সরকার । বিরোধী না হয়েও নরসিমা রাও সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছিল বিজেপি । কূটনৈতিকমহলের মতে, মনমোহন সিংয়ের এই সিদ্ধান্তের ভিতকেই একবিংশ শতকের গোড়ায় নিজের পাঁচ বছরের সরকারের ভরপুর কাজে লাগিয়েছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী । ওয়াশিংটনে তাঁর সঙ্গে জর্জ বুশ জুনিয়রের সেই হ্যান্ডসেক খুলে দিয়েছিল ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নতুন দরজা ।
বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাজপেয়ী যে হাত শক্ত করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী হয়ে সেই রাস্তায় হেঁটেছিলেন মনমোহন সিং । তাই, বন্ধু বামেদের শত বাধা সত্ত্বেও আমেরিকার সঙ্গে তাঁর ওয়ান টু থ্রি চুক্তি ছিল ইউপিএ ওয়ান সরকারের অন্যতম মাইলস্টোন । রাজনৈতিক মহল দাবি করেন, এই একটি চুক্তি দিল্লির মসনদে তাঁর মেয়াদকে আরও পাঁচ বছর বাড়িয়ে দিয়েছিল ।
পালাবদল হয়েছে দুই দেশেই । কংগ্রেস গিয়ে বিজেপি এসেছে । ডেমোক্র্যাটদের গদি ছিনিয়ে নিয়েছেন রিপাবলিকানরা । কিন্তু এই পালাবদল দিল্লি-ওয়াশিংটনের বন্ধুত্বের কোনও টোল ফেলতে পারেনি । বরং ওবামা, ট্রাম্প, বাইডেন যেই এসেছেন ওয়াশিংটনে, তাঁরাই বাড়িয়ে দিয়েছেন দিল্লির দিকে হাত । কারণ, উপমহাদেশের বাজার আর এই অঞ্চলে চিনকে রোখার সাহস । এই দুই কারণেই মূলত আরও কাছাকাছি এসছে দুই দেশ । এই সময়ের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের দৃঢ়তা যেমন বেড়েছে, তেমনই বাণিজ্যে নতুন দুয়ার খুলেছে অস্ত্র লেনদেনের মাধ্যমে ।
ভারতীয় নৌ-সেনার সঙ্গে আজ যৌথ মহড়া করে আমেরিকান নেভি সিলস । ভারতীয় নিরাপত্তাকে ঢেলে সাজাতে তৈরি করা হয়েছে মার্কিন ধাঁচে সোয়াৎ বাহিনী । এই বাণিজ্য বন্ধুত্বের মধ্যেও নিজের বিদেশনীতির মধ্যে ভারত কিন্তু আমেরিকাকে কখনও নাক গলাতে দেয়নি । যার উদাহরণ উরি পরবর্তী সময়ে দিল্লির সার্জিকাল স্ট্রাইক নিয়ে পাত্তাই দেওয়া হয়নি ওয়াশিংটনের মন্তব্যকে । দিল্লি বুঝিয়ে দিয়েছে এই সিদ্ধান্ত একেবারেই অভ্যন্তরীণ । যেখানে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা বরদাস্ত করবে না ভারত ।
এই প্রেক্ষাপটেই মোদী-ট্রাম্পের নয়া ইনিংস । তৈরি হচ্ছে প্রত্যাশা । দীর্ঘ হচ্ছে চাওয়া-পাওয়ার তালিকা । যা খবর, তাতে ট্রাম্পের প্রথম বিদেশ সফরই হতে পারে দিল্লি । আগামী বছরের গোড়ায় ভারতের মাটি ছুঁতে পারে এয়ারফোর্স ওয়ান । যেখানেই তৈরি হতে পারে ভারত-মার্কিন সম্পর্কের নতুন স্বপ্ন ।
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসায় ভারতের লাভ কি হবে ? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা ?
প্রাক্তন কূটনীতিক ও কংগ্রেস নেতা শশী থারুরের মতে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়, ভারতের জন্য ভাল কিছুর সম্ভাবনা । তবে, তাঁর মতে চার বছর ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে আগেও পেয়েছে ভারত । তাই খুব বেশি অবাক হওয়ার কিছু নেই । সেইসঙ্গে খুব বেশি যে চমকপ্রদ লাভ হবে, তাও বলা যাচ্ছে না । অন্যদিকে, বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর বিশ্ব অর্থনীতির পাশাপাশি ভারতের জন্য ট্রাম্পের নীতিগুলি আরও ফলপ্রসূ হতে পারে ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এনার্জি, আইটি ,সেমিকন্ডাক্টরের মতো ক্ষেত্র উপকৃত হতে পারে । তেলের দাম কমতে পারে । এছাড়া, H-1B ভিসা নিয়ে আইন, বাণিজ্য ও স্টক মার্কেটের মতো বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতি নির্ধারণ করবে আগামী দিনে ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক কোন পথে এগোবে।