শিল্পীদের পরিচয় তাঁদের শিল্পেই। ঠিক করা। তবে শিল্পীরাও তো ঘরের মানুষ, কারোর না কারোর। কাছের মানুষগুলোর শিল্পস্রষ্টাকে একটু অন্যভাবেই পান। কেমন ছিলেন বাবা মৃণাল সেন। 'ভুবন সোম', 'কলকাতা ৭১', 'আকালের সন্ধানের-র মতো ' আন্তর্জাতিক মানের বাংলা ছবি বানানো মানুষটার ৯৯ তম জন্মবার্ষিকীর ঠিক আগে এডিটরজি বাংলার কথা হয়েছিল তাঁর ছেলে কুণাল সেনের সঙ্গে।
পরিচালকের ১০১ তম জন্মবার্ষিকীতে রইল সেই কথোপকথনের অংশঃ
পরিচালক মৃণাল সেনের কথা আমরা কম-বেশি অনেকেই জানি। বাবা মৃণাল সেন কেমন ছিলেন? আপনাদের কেমন সম্পর্ক ছিল?
আমি ওঁকে বাবা ডাকতাম না। 'বন্ধু' ডাকতাম। তবে শুরু থেকেই বাবার সবচেয়ে বড় সমালোচক ছিলাম আমি। আমার খুব অল্প বয়স থেকেই বাবা তাঁর ছবির চিত্রনাট্য রোজ আমাকে আর মাকে আমাদের পড়ে শোনাতেন । আমার কাজ ছিল খুঁত বের করা। একই সঙ্গে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, আবার জীবনের প্রতিটা ধাপে আমরা নিজেদের চ্যালেঞ্জ করেছি। অসমবয়সী একটা বন্ধুর সম্পর্ক। যার সঙ্গে মতের অমিল হয়। যার প্রতি নিয়মমাফিক আনুগত্য দেখাতে হয় না, তেমন এক বন্ধু।
বাবা মৃণাল সেন, আপনার বড় হওয়ার মধ্যে এই বোধটা সবসময় থেকেছে?
বাবাকে নিয়ে গর্ব ছিল না, তেমনটা নয়, কিন্তু সেটা সচেতন ভাবেই চিরকাল আড়াল করার চেষ্টা করেছি। বাবা-র 'কলকাতা ৭১' মুক্তি পেয়েছিল কলকাতার একটাই হলে। একবার ঠিক করেছি বন্ধুদের নিয়ে দেখতে যাব। সকাল থেকে, বিশাল লম্বা লাইনে ঠায় দাঁড়িয়ে সবাই। আমিও দাঁড়িয়েছি বন্ধুদের সঙ্গে। হঠাৎ আমায় দেখতে পেলেন প্রোডাকশন ম্যানেজার। ওরা তখন লাইন থেকে বের করছেন আমাকে। লাইনে কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা বাকিদের দিকে তাকাতেই আমার তখন সে কী অস্বস্তি! আমি তো সিস্টেমের বাইরে নই! বাবার পরিচয় দিয়ে কিছু করতে আমি কখনই চাইনি, বাবাও কোনওদিন প্রশ্রয় দেননি।
আপনার বাবার মতো মায়েস্ত্রোরা যখন সিনেমা বানিয়েছেন, তার থেকে বর্তমান সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কতোটা পালটেছে বলে আপনার মনে হয়?
আমার বাবা চিরকালই খুবই রাজনৈতিক ছবি বানাতেন, দক্ষিণপন্থার ঘোর বিরোধিতা করতেন। সেটা নিয়ে তীব্র সমালোচনা তখনও হতো, তবে কাজের স্বীকৃতি দেওয়া হতো তখন। বাবার ছবিই তো কেন্দ্রীয় সম্মান পেয়েছে। আমাদের দেশের রাজনীতিতে একধরনের সফিস্টেকেশন ছিল, শিল্প-সংস্কৃতিতে রাজনীতির ছায়া এখনকার মতো তখন এতটা ছিল না। এখন সিস্টেমের বিরুদ্ধে কথা বললে ছবি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। যার জন্য এখনকার ছবি গুলোও যেন বড় সাবধানী।
বাবার সঙ্গে সিনেমাহলে গিয়ে সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
আমরা শব্দ সিনেমাটা শেষ একসঙ্গে দেখেছিলাম হলে গিয়ে। বাবার খুব ভাল লেগেছিল ছবিটা। আর নতুনদের কাজ দেখতে খুব পছন্দ করতেন। পুনে থেকে ফিরলেই দেখতাম, এক ঝাঁক তরুণ মুখের সঙ্গে থেকে, কথা বলে বাবা খুব আনন্দে থাকতেন।