সীমাবদ্ধ, কিমবা নায়ক অথবা কাঞ্চনজঙ্ঘা! সত্যজিৎ রায়ের কাল্ট ছবি সব। ফিল্ম স্টাডিজের পড়ুয়াদের কাছে টেক্সট বই-এর মতো সিনেমা সব। তবে, ভারতীয় সিনেমার টেকনিকাল খুটিনাটি পাশে সরিয়ে রাখলেও এই সব সিনেমা অভিনব আরও একটি কারণে। এ দেশের মেয়েদের, চরিত্রের আটঘাট, বিশ্লেষণ সমসাময়িক চলচ্চিত্র নির্মাতাদের থেকে সত্যজিৎকে এগিয়ে রেখেছিল অনেকটাই। তবে, এ প্রসঙ্গে ঋত্বিক ঘটকের কোমল গান্ধার, মেঘে ঢাকা তারা, সুবর্নরেখার নাম না করাটা রীতিমতো অন্যায়। তারপর বাংলা মননশীল দর্শক পেয়েছে অপর্না সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষের মতো সংবেদনশীল পরিচালকদের। তবে, একটা ব্যাপার স্পষ্ট, গত শতকে মূল ধারার বাংলা ছবিতে নারী কেন্দ্রিক চরিত্র প্রাধান্য প্রায় পায়নি বললেই চলে। যে সব ছবিতে নারী চরিত্ররা কেন্দ্রে, তা 'আর্ট ফিল্ম'-এর তকমা পেলেও বাণিজ্যিক ছবির খোপে তাদের ফেলা হতোনা বললেই চলে।
চেনা এই ছবিটা বদলাচ্ছে, দ্রুত বদলাচ্ছে। বলিউডে, নারীকেন্দ্রিক ছবি বললেই চোখে ভাসে বেশ কয়েকজন অভিনেত্রীর নাম। বিদ্যা বালান। কঙ্গনা রানাওয়াত, আলিয়া ভাট, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া। এবার সেই ট্রেন্ড ঢুকে পড়ছে টলিউডেও। একটা- দুটো-তিনটে ব্যতিক্রমী অন্যধারার ছবি নয়। ভাবতে ভাল লাগে, মূল ধারার ছবি হিসেবেই টালিগঞ্জে জায়গা করে নিচ্ছে একগুচ্ছ নারীকেন্দ্রিক ছবি।
সম্প্রতি, গোটা ভারতে আলোড়ন ফেলে দিয়ছে রামকমল মুখোপাধ্যায় পরিচালিত নটি বিনোদিনীর বায়োপিক। নাম ভূমিকায় অভিনয় করা রুক্মিণী নিজেই জানিয়েছিলেন, এটা একটা ছবি নয়, এটা একটা আন্দোলন। কোনটা আন্দোলন? বিনোদিনী দাসীর পিতৃতান্ত্রিক সমাজকে চ্যালেঞ্জ করাটাও যেমন আন্দোলন, ২০২৫-এ দাঁড়িয়ে বিনদিনীর জীবনকে পর্দায় ফুটিয়ে তোলা সিনেমা দেখতে দর্শককে হলমুখী করাটাও, আন্দোলন। অবশ্যই।
তবে, বিনোদিনীর আগেই সেই ট্রেন্ড এসেছে বাংলায়। নারীকেন্দ্রিক ছবি, হল ভরাচ্ছে, মাল্টিপ্লেক্স ভরাচ্ছে কলকাতা শহরে, মফঃস্বলে এমন কী গ্রামেও।
আজ, এডিটরজি বাংলার দর্শকদের জন্য রইল, বাংলা চলচ্চিত্রের তেমনই কয়েকজন অভিনেত্রী এবং তাঁদের অভিনীত ছবি, কিম্বা সিরিজের নাম।
কোয়েল
কমার্শিয়াল টলিউড ছবির অঘোষিত ফার্স্ট লেডি কিন্তু এখন টলিপাড়ার জনপ্রিয় 'গোয়েন্দা গিন্নি'। মিতিন মাসি হিসেবে দারুণ হিট কোয়েল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, মিতিন মাসি কিন্তু, একবার বড়পর্দায় এসে হারিয়ে যায়নি। বরং ফেলুদা ব্যোমকেশ, একেন বাবুদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মিতিন মাসি ফ্র্যাঞ্চাইজি এখন বেশ হিট।
স্বস্তিকা
কেরিয়ারের শুরুতে স্বস্তিকা ,মেইন স্ট্রিম, কমার্শিয়াল ছবি করেছেন, একের পর এক। সে সব ছবি হিরোসেন্ট্রিক। কিন্তু বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় অন এবং অফস্ক্রিন নিজেকে 'বোল্ড' হিসেবেই প্রেসেন্ট করেছেন, নানা সাক্ষাৎকারে টলিউডের পিতৃতন্ত্রের চেনা ছককে প্রশ্ন করেছেন। মৈনাক ভৌমিকের 'টেক ওয়ান' হোক, বা 'ফ্যামিলি অ্যালবাম' , বা 'শিবপুর', ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য তৈরি ছবি, 'শ্রীমতি', ওয়েব সিরিজ 'নিখোঁজ'।
শুভশ্রী
আবারও এমন এক অভিনেত্রীর কথা বলব, যিনি কয়েক বছর আগে পর্যন্ত ছিলেন কমার্শিয়াল ছবির হিরোইন। সেখান থেকে আমূল ট্রান্সফর্মেশন। কেরিয়ারের মাঝগগনে থেকে শুভশ্রী বেছে নিলেন 'ইন্দুবালা ভাতের হোটেল'-এর মতো ওয়েব সিরিজ, মুখে বলিরেখা পড়া ডিগ্ল্যামারাইজড লুক। তাছাড়া বক্স অফিসে যেমনই সাফল্য পাক, বুদ্ধদেব গুহর জনপ্রিয় উপন্যাস আশ্রিত ছবি 'বাবলি'তে নাম ভূমিকায় অভিনয় করলেন । জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত পরিচালক শুভ্রজিৎ মিত্রের 'রায়বাঘিনী ভবশংকরী'র অফিসিয়াল অ্যানাউন্সমেন্ট হয়ে গিয়েছে।
শ্রাবন্তী
শুভ্রজিতের পরিচালনায় কুইন অফ বেঙ্গল ট্রিলজির প্রথম ছবি 'দেবী চৌধুরানি' আসছে। এই ছবি শুধু, বঙ্কিমের উপন্যাস অবলম্বন করেই ছবির গল্প নয়, বেশ খানিকটা ইতিহাসমিশ্রিত ছবি। লার্জার দ্যান লাইফ চরিত্রে শ্রাবন্তীর এটি প্রথম ছবি হলেও অপর্না সেন পরিচালিত 'গয়নার বাক্স' অতি অবশ্যই নারীকেন্দ্রিক ছবিই ছিল।
পাওলি
পাওলির অসাধারণ অভিনয় প্রতিভার পরিচয় টলিউড-বলিউড পেয়েছে আগেই। চলচ্চিত্রে দেবেশ চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত 'নাটকের মতো' ছবিতে পাওলির অসধারন স্ক্রিন প্রেসেন্স আমাদের মুগ্ধ করেছে। পরিচালক ইন্দ্রানী চক্রবর্তীর ছবি 'ছাদ' মুক্তির অপেক্ষায়। এ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছেন পাওলি। তাছাড়া 'কালবেলা' কি শুধু অনিমেষের গল্প? 'বিপ্লবের আরেক নাম মাধবীলতা', সেই মাধবীলতার চরিত্রে আমরা পেয়েছি পাওলিকে।
ঋতাভরী
টলিউডে অভিনয়ের জন্য যতোটা প্রশংসা কুড়িয়েছেন, ততোটাই শিরোনামে এসেছেন চাঁচাছোলা স্বভাবের জন্য। সাহসী চরিত্র হোক অথবা সাহসী স্টেটমেন্ট, প্রথমেই মনে আসে ঋতাভরী চক্রবর্তীর নাম। ফাটাফাটি, ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি শুধু নারীপ্রধান ছবি বললে কম বলা হয়, দু'টি ছবিতেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্টিরিওটাইপ ভাঙা হয়েছে প্রতি পরতে পরতে। মৈনাক ভৌমিক পরিচালিত গৃহস্থ-ও বলে দেয়, সে ছবিতেও পিতৃতন্ত্রের দিকে একরাশ প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবে ঋতাভরীর চরিত্রটি।
সোহিনী-সন্দীপ্তা ওয়েব সিরিজ
কোভিডোত্তর কালে বাংলা বিনোদনের নতুন ঠিকানা ওটিটি। তাই টলিউড বললে, তা এখন আর শুধু বড়পর্দা, বক্স অফিসে সীমাবদ্ধ থাকছে না। বাংলা ওটিটি-তেও এখন নারীকেন্দ্রিক কন্টেন্টের ছড়াছড়ি। সোহিনী সরকার অভিনীত 'সম্পুর্না' ১, ২, সন্দীপ্তার 'বোধন'-এর কথা আলাদা করে বলতেই হয়।