ঋতুস্রাব বা পিরিয়ড কোনও অসুস্থতা নয় । একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া । বৈজ্ঞানিক দিক থেকে শুনতে ভাল লাগলেও, বাস্তবটা একেবারে অন্যরকম । মেয়েদের কাছে মাসিকের ওই কয়েকটা দিন বিভীষিকার মতো । ঋতুস্রাব চলাকালীন পেটে অসহ্য যন্ত্রণা হয়, অনেকে বিছানা থেকে উঠতে পারেন না । কারও ক্ষেত্রে যন্ত্রণার তীব্রতা এতটাই বেশি থাকে যে, হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয় । এছাড়া দিনভর ক্লান্তি, মুড সুইয়িং...শারীরিক, মানসিক যন্ত্রণা...মাসের পাঁচটা দিন ঝড় বয়ে যায় একটা মেয়ের উপর দিয়ে । বিশেষ করে যাঁরা কাজে বেরোন, মাসিকের দিনগুলিতে যে কত সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়, তা তাঁরাই জানেন । এদিকে, পিরিয়ডের দিনগুলির মধ্যে অন্তত একটা দিন অফিস থেকে যে ছুটি নেবেন, তারও সুযোগ থাকে না সবসময় । আবারও অনেকে ছুটি নিতে সংকোচও বোধ করেন । অথচ জানেন কি, বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে মহিলা কর্মীদের জন্য পিরিয়ড লিভ চালু করেছে বিভিন্ন অফিস । সিক লিভ, ম্যাটারনিটি লিভ-সহ একাধিক লিভ থাকলে, কেন পিরিয়ড লিভ নয়, বর্তমানে সেই প্রশ্নই তুলছেন মেয়েরা, বিশেষ করে ভারতের মেয়েরা । অবশ্য ইতিমধ্যেই পিরিয়ড লিভ চালু হয়েছে দেশের কয়েকটি রাজ্য । সেই তালিকায় সম্প্রতি নাম লিখিয়েছে ওড়িশা ।
চলতি বছর স্বাধীনতা দিবসের দিনই ওড়িশা সরকার জানিয়েছিল,শীঘ্রই মহিলা কর্মীদের জন্য তারা সবেতন ঋতুকালীন ছুটি আনতে চলেছে । এবার তাতেই সিলমোহর দিল সরকার । ২০২৪ সালের নভেম্বর মাস থেকেই পিরিয়ড লিভ কার্যকর হতে চলেছে সরকারি ও বেসরকারি দুই ক্ষেত্রেই । ওড়িশা সরকার জানিয়েছে,কর্মরত মহিলারা মাসে এক দিন করে ঋতুকালীন ছুটি নিতে পারবেন । অর্থাৎ বছরে মোট ১২টি ছুটি । ঋতুচক্রের প্রথম কিংবা দ্বিতীয় দিন মিলবে ছুটি । মূলত তা ক্যাজ়ুয়াল লিভ বলেই গণ্য হবে । ওড়িশায় এখন মহিলাদের জন্য বার্ষিক সিএল-এর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৭ ।
ঋতুকালীন ছুটি প্রথম কোথায় চালু হয় ?
সর্বপ্রথম স্পেনে ঋতুকালীন ছুটি কার্যকর হয় । আইন করে বাধ্যতামূলক পিরিয়ড লিভ চালু করে স্পেন । তারপর একে একে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়াতেও এই বিশেষ ছুটি চালু হয় । সেক্ষেত্রে, দিন বদলের ডাক প্রথম দিয়েছে স্পেনই
ভারতে পিরিয়ড লিভ
ভারতে যে সব রাজ্যে পিরিয়ড লিভ চালু হয়েছে, তার মধ্যে অবশ্য ওড়িশা তৃতীয় । এর আগে বিহার ও কেরলে পিরিয়ড লিভ চালু হয়েছে কর্মরত মহিলাদের জন্য । ১৯৯২ সালে এই বিশেষ ছুটির ঘোষণা করে তৎকালীন সরকার । সেইসময় মাসে দুই দিন সবেতন ছুটির ঘোষণা করা হয় । কেরলেও ঋতুকালীন ছুটির নীতি চালু রয়েছে । অন্যদিকে, কর্নাটকও সেই পথে হাঁটতে পারে । বছরে ছ’দিন মহিলা কর্মীদের জন্য বাধ্যতামূলক সবেতন পিরিয়ড লিভের ভাবনা-চিন্তা করছে কর্নাটক সরকার । বিষয়টা আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে । সব ঠিক থাকলে ঋতুকালীন ছুটি কার্যকরের তালিকায় চতুর্থ রাজ্য হতে চলেছে কর্নাটক । এমনকী, জোম্যাটোর মহিলা কর্মীরা ২০২০ সাল থেকে বছরে ১০ দিন সবেতন ঋতুকালীন ছুটি পান ।
পশ্চিমবঙ্গেও পিরিয়ড লিভ চালুর দাবি উঠছে । যদিও, সেই বিষয়ে এখনও কিছু ভেবে দেখেনি পশ্চিমবঙ্গ সরকার ।
পিরিয়ড লিভ নিয়ে বিতর্ক
পিরিয়ড লিভ নিয়ে বিভিন্ন মহলে দ্বিমত রয়েছে, যা বিতর্ক তৈরি করছে নতুন করে । অনেকে বলছেন পিরিয়ড লিভ চালু হলে মহিলাদের প্রতি বৈষম্য হতে পারে বলে মনে করেন অনেকে । যেমন বিজেপি নেত্রী স্মৃতি ইরানি জানিয়েছিলেন, ঋতুস্রাব মহিলাদের জীবনের একটি স্বাভাবিক অংশ, এটি কোনও প্রতিবন্ধকতা নয় । তাঁর মতে এমন কোনও প্রস্তাব রাখা উচিত নয়, যেখানে মহিলাদের সমান সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হয় ।
স্মৃতির মতোই অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, পিরিয়ড লিভ কি আদৌ মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে কোনও সুবিধা দেবে ? নাকি বিশেষ ছুটি দিলে মেয়েদের দুর্বলতাকেই প্রমাণ করার চেষ্টা করা হবে ? সাধারণ মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়েই অনেকে কটাক্ষ করে থাকেন এই বলে যে মেয়ে হলে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায় । সেক্ষেত্রে পিরিয়ড লিভ নিয়েও স্বভাবত প্রশ্ন উঠছে । আসলে, সমাজ যে এখনও নারীদের এখনও পিছিয়ে রাখার, দমিয়ে রাখার চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে ।
কারও আবার বক্তব্য, প্রত্যেক সংস্থাতেই ক্যাজুয়াল লিভ, পেইড লিভ বা আর্নড লিভ থাকে । সেক্ষেত্রে আলাদা করে পিরিয়ড লিভ চালু করার কোনও যুক্তি নেই ।
পিরিয়ড লিভ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট
কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের ঋতুকালীন ছুটি বাধ্যতামূলক করার আবেদন জানিয়ে একটি জনস্বার্থ মামলা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে । যদিও আবেদন খারিজ করে দেয় শীর্ষ আদালত । সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ, পিরিয়ড লিভ বাধ্যতামূলক করা হলে মহিলারা কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়তে পারেন । এমন নির্দেশ তাঁরা দিতে চান না যে তাতে মহিলাদের কোনও ক্ষতি হয় । ঋতুকালীন ছুটির বিষয়ে হস্তক্ষেপ তাঁরা করবেন না বলেও জানিয়ে দেন । সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দেয়, পিরিয়ড লিভ নিয়ে রাজ্যগুলি ও কেন্দ্র আলোচনা করে একটি নীতি তৈরি করুক ।
পিরিয়ড লিভ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা কী জানাচ্ছেন ?
পিরিয়ড চলাকালীন তলপেটে যে অসহ্য যন্ত্রণা হয়, ডাক্তারি ভাষায় তাকে বলা হয় ডিসমেনোরিয়া । যাঁদের হালকা যন্ত্রণা, তাঁদের ক্ষেত্রে বলা হয় প্রাইমারি ডিসমেনোরিয়া । ব্যথা মারাত্মক হলে ডাক্তারি ভাষায় বলা হয় সেকেন্ডারি ডিসমেনোরিয়া ।
প্রাইমারি ডিসমেনোরিয়া-র উপসর্গ
তলপেট, কোমর, পায়ে ব্যথা, বমি বমি ভাব , মাথা ঘোরা , পেটে সমস্যা ইত্যাদি
সেকেন্ডারি ডিসমেনোরিয়া-র উপসর্গ
তলপেটে তীব্র যন্ত্রণা
একইসঙ্গে কোমর, পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাইমারি ডিসমেনোরিয়া হলে যন্ত্রণা সহ্য করা যায় । কিন্তু, সেকেন্ডারি ডিসমেনোরিয়া-র ক্ষেত্রে কোনও কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে মেয়েদের পক্ষে । অনেককে হাসপাতালেও ভর্তি করতে হয় । এতে কাজের ক্ষতি হয় । মানসিক স্বাস্থ্য আরও খারাপ হয় । সেক্ষেত্রে, ঋতুকালীন ছুটিটা প্রয়োজন বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা ।
কিন্তু পিরিয়ড লিভের মধ্যে কি ইটভাটায় কর্মরত মহিলারা পড়ছেন ? কিংবা বাড়ির পরিচারিকারা ? একেবারেই না । শুধু তাই নয়, যাঁরা ঘর সামলাচ্ছেন, সেইসব মহিলাদের কথা ভাবেন না কেউ । যতই পিরিয়ডের যন্ত্রণা থাকুক বা শরীরে দুর্বলতা, কোনও টু শব্দ না করেই সবার জন্য রান্না করছেন, ঘর গোছাচ্ছেন । তাঁদের কথা কে ভাববে ? সেই দায়িত্বটা আমার-আপনার উপরই বর্তায় বটে ।