বেড়াতে যাওয়ার চেয়ে আনন্দময় আর কী আছে? প্রতিদিনের জীবনযাপনের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে, শরীর-মন একদম চাঙ্গা, সতেজ করে তুলতে ভ্রমণের কোনও বিকল্প নেই৷ কিন্তু অনেকের কাছেই বেড়াতে যাওয়া হয়ে ওঠে রীতিমতো আতঙ্কের। বাক্সপ্যাঁটরা বেঁধে বেড়াতে যাওয়ার আগে রীতিমতো উদ্বেগ ও আতঙ্কে ভোগেন তাঁরা। অনেকে তো অসুস্থও হয়ে পড়েন৷ এই সমস্যার পোশাকি নাম হল, ট্র্যাভেল অ্যাংজাইটি। বাংলায় বলা যেতে পারে, ভ্রমণ সংক্রান্ত উদ্বেগ৷
দেখুন, বেড়াতে যাওয়া নিয়ে টুকটাক টেনশন তো সকলেরই থাকে৷ ঠিক সময়ে উঠে প্রস্তুত হতে পারব তো? ট্রেন/বাস/প্লেন মিস করব না তো? সবকিছু ঠিকভাবে গোছগাছ করেছি তো? যেখানে যাচ্ছি, সেখানকার আবহাওয়া ঠিক থাকবে তো? নইলে যে সবটুকু টাকাই জলে যাবে! বাড়ি বা অফিসের সব কাজ গুছিয়ে করে রাখা হয়েছে তো? ওখানে গিয়ে আবার যেন এসব নিয়ে চাপ নিতে না হয়!- এমন সব টেনশন তো থাকবেই৷ কিন্তু যখন এই উদ্বেগের তীব্রতা অনেকখানি বেড়ে যায়, তখনই হয় বিপদ। চিকিৎসকরা কিন্তু বলছেন, ট্র্যাভেল অ্যাংজাইটিকে মোটেই হালকাভাবে নেওয়া যাবে না৷ ঠিক সময়ে চিহ্নিত করতে হবে উদ্বেগের কারণগুলিকে, অর্থাৎ 'ট্রিগারগুলি' চিনতে হবে, সেগুলির সমাধান করতে হবে৷ প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হতে হবে।
শুধু, সাধারণ মানুষেরই যে উদ্বেগ হয়, তাই নয়, অ্যাংজাইটিতে ভুগতেন স্বয়ং মহানায়ক উত্তম কুমারও, বিমানে সফর করার ক্ষেত্রে উত্তম কুমারের রীতিমতো ভয় ছিল। বলিউড অভিনেতা ভিকি কৌশলও হাইড্রোফোবিয়ায় ভোগেন বলে নিজেই জানিয়েছেন। ভিকি-র ভয়, কোনওদিন একটি দ্বীপে আটকে যান যদি!
যাঁদের অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার আছে, তাঁদের ট্র্যাভেল অ্যাংজাইটি থাকা ভীষণ স্বাভাবিক। বেড়াতে যাওয়ার আগে এই মানুষরা ভীষণ উদ্বেগে ভোগেন৷ আমেরিকার অ্যাংজাইটি অ্যান্ড ডিপ্রেশন অ্যাসোসিয়েশনের রিপোর্ট বলছে, বহু মানুষ বিমানে উঠতে ভয় পান। দ্রুতগামী ট্রেনে চড়তেও ভয় পান অনেকে। দমবন্ধ বোধ হয় তাঁদের। এছাড়াও ট্র্যাভেল অ্যাংজাইটির জেরে হৃৎস্পন্দনের গতি ভীষণ বেড়ে যেতে পারে। প্রবল ঘাম হতে ওারে। শুধু তাই নয়, আশেপাশের মানুষজন কী ভাবছেন, তা নিয়েও ভাবতে শুরু করেন অনেক, যা অ্যাংজাইটিকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
বেড়াতে যাওয়ার কয়েকদিন আগে থেকেই অনেকের উদ্বেগে ঘুম কম হয়৷ অস্থির বোধ করেন সারাদিন৷ নিজের অশান্তি ও উদ্বেগ চেপে রাখতে পারেন না৷ সর্বসমক্ষে প্রকাশ করে ফেলেন৷ রীতিমতো বুকে ব্যাথা শুরু হয় অনেকের। ডায়রিয়া হতে পারে৷ বার বার টয়লেটে যেতে হয়৷ কোনও কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারেন না। সবমিলিয়ে বেড়ানোর মজা তো মাটি হয় বটেই, অসুস্থ হয়েও পড়েন।
কী কী ধরণের চিন্তা আসে মাথায়? কয়েকটি তো আগেই বললাম৷ তার বাইরেও মনে হয়, বেড়াতে গিয়ে যদি হারিয়ে যাই, তাহলে কী হবে? যদি সব টাকাপয়সা ফুরিয়ে যায়, কার্ড হারিয়ে যায়, ফোন চুরি হয়ে যায়, কী করব তখন? বেড়াতে গিয়ে যদি অফিসের ফোন আসে, জানতে পারি বহু কাজ বাকি রেখে এসেছি, তখন কী করব? এমন অজস্র দুর্ভাবনা আচ্ছন্ন করে ফেলে।
কিন্তু ট্র্যাভেল অ্যাংজাইটি থেকে মুক্তির উপায় কী? প্রথমত, রিল্যাক্স করুন। রিল্যাক্স করতে শেখা ভীষণ ভীষণ জরুরি৷ একদম চাপ নেবেন না। মনে রাখবেন, আপনি বেড়াতে যাচ্ছেন, এই সময়টুকুর মালিক আপনি, ঘর-বাড়ি-অফিস কোনও চাপ যেন এই অমূল্য সময়টাকে নষ্ট না করে।
দ্বিতীয়ত, গুছিয়ে প্ল্যানিং করুন। একদম দিন ধরে ধরে পরিকল্পনা করে ফেলুন। গোটা ট্রিপটা নিখুঁত হাতে সাজিয়ে ফেলুন অনেক দিন আগেই৷ তাহলেই আর উচাটনের কারণ থাকছে না।
তৃতীয়ত, আপনি এনজয় করতে যাচ্ছেন। কোনও পরীক্ষা দিতে বা অ্যাসাইনমেন্টে নয়। তাই যদি আপনার প্ল্যানিং অনুযায়ী সব ১০০ শতাংশ না মেলে, তাহলে টেনশন করবেন না। বরং সময়টা উপভোগ করুন৷ একটা কফির কাপ নিয়ে বসুন। দেখবেন, ভালো লাগবে।
তৃতীয়ত, সম্ভব হলে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যান৷ এমন ভ্রমণসঙ্গী বাছুন, যিনি নিজেও দিলখোলা, উপভোগ করতে জানেন। যাঁর উপরে নির্ভর করা যায়, যিনি নিজে হাইপার হন না। তাহলেই আপনার ভ্রমণ যাকে বলে 'সৎস্বর্গে স্বর্গবাস', তাই হবে।
চতুর্থত, অনেকের ট্র্যাভেল অ্যাংজাইটির নেপথ্যে থাকে পূর্ববর্তী কোনও ভ্রমণের খারাপ অভিজ্ঞতা। বেড়াতে যাওয়ার আগে সে সব মাথা থেকে জাস্ট উড়িয়ে দিন। পুরনো খারাপ অভিজ্ঞতা মুছতে চেয়েই তো আপনা এবারের বেড়িয়ে পড়া, তাই না?
আর যদি এত কিছুর পরেও দেখেন উদ্বেগ কমছে না, তাহলে চট করে একবার মনেবিদের চেম্বারে ঢুঁ দিতে ভুলবেন না।