জটিল জীবনে সবচেয়ে কঠিন হয়ে উঠছে, কোন জিনিসটা বলুন তো? সহজ থাকা। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, "সুখী হওয়া খুব সহজ, কিন্তু সহজ হওয়া খুব কঠিন।"। এই সহজ জীবনের পাসওয়র্ড আমরা সবাই খুঁজেই চলেছি। কিন্তু নানা লেখাপড়া করে, হিসেব করে যেই পাসওয়র্ড দিই, জীবনের কম্পিউটার বলে ওঠে 'ইনকারেক্ট পাসওয়র্ড'...
ভারী মুশকিল না? কিন্তু সূর্যোদয়ের দেশ, জাপান কিন্তু ভাল থাকার নানা টেকনিক বার করে চলেছে প্রতিদিন। আর সেই সব মেনে চলার চেষ্টা করছে গোটা দুনিয়া। তেমনই এক টেকনিক মিনিমালিজম।
মিনিমালিজম কী? এক কথায় উত্তর দিতে বললে বলব সহজ ভাবে বাঁচার উপায়। সেই উপায় বলে, শুধু যেটুকু প্রয়োজন, সেটুকু থাকলে ভাল থাকা সহজ। চাহিদা কমাতে হবে। আরও চাই, আরও আরও- এই ভাবনা টা থেকে বেরোতে হবে।
মিনিমালিজম বা ন্যূনতমতাবাদ একটি দার্শনিক ধারণা, যা ২০শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মিনিমালিজমের লক্ষ্য হলো অপ্রয়োজনীয় আতিশয্য বাদ দিয়ে একেবারে মৌলিক প্রয়োজন যা কিছুর, তা নিয়ে বাঁচা। জাপানিদের মিনিমালিসমের আদর্শের প্রতিফলন সবচেয়ে বেশি করে হয়, তাঁদের ঘরবাড়ির সাজসজ্জায়। অধিকাংশ জাপানি বাড়িতে ঢুকলেই মনে হয়, ঘরটা যেন ফাঁকা ফাঁকা। আসবাব কম, প্রয়োজনীয় সামগ্রীর বাইরে বাড়তি কিছুই নেই।
বসার আরেকটা জায়গা থাকলে ভাল হতো না? কিমবা দেওয়ালে একটা ছবি, টেবিলের ওপর দুটো সুন্দর শো পিস রাখা যেত না? কিমবা বারান্দায় বাড়তি একটা ল্যাম্প শেড? হাত নিশপিশ করবে সেসব দিয়ে ঘর সাজাতে, কিন্তু নিজেকে সংযত হতে হবে মিনিমালিজমকে আয়ত্তে আনতে হলে। রোজ নতুন আইফোন, ল্যপটপ, স্মার্ট ফোনের মডেল আসছে বাজারে, আপনার সংগ্রহে না থাকলে পিছিয়ে পড়বেন ভাবছেন? আসলে, কিন্তু তা নয়। দু'দিন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকলে, উইকেন্ডে সোশ্যালাইজ না করলে, জীবনে কিছু হারায় না, এটাই বলতে চাইছেন মিনিমালিস্টরা।
বেঁচে থাকতে গেলে, কিছু জিনিস সত্যিই প্রয়োজন, আর তার বাইরে অনেক কিছুই আতিশয্য, বাড়াবাড়ি। না হলেও চলে যায় এবং বেশ ভালভাবেই চলে যায়। মিনিমালিজম আসলে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, যা কিছু নিয়ে চলছি, তার সবটুকুর কী প্রয়োজন, আমার জীবনে? আচ্ছা, এখানে মনে হয়তে পারে, মিনিমালিজম আদর্শ শৌখিনতার বিরুদ্ধে কথা বলে। তা নয়। মিনিমালিজমের অর্থ, যেমন তেমন করে বাঁচা নয়। বরং, প্রাচুর্জকে বাদ দিয়ে যেটুকু নিয়ে আপনি সত্যিই ভাল থাকবেন, সেটুকু নিয়ে থাকা। কোনও বিশেষ জিনিসে আপনার শখ নিশ্চয়ই থাকতে পারে। তবে মাইন্ডলেস বাইং কে প্রশ্রয় না দিয়ে আপনার প্রয়োজন এবং ভালোলাগার মধ্যে একটু ব্যালেন্স করে চলা।
বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে মিনিমালিজমের আদর্শের এক নিবিড় যোগ রয়েছে। জাপানে এই ধর্মের প্রভাব বেশি থাকায় খুব স্বাভাবিক ভাবেই মিনিমালিজমের আদর্শ এখানেই সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়েছে।
জীবন, ক্রমশ দ্রুত হচ্ছে, এমনই তীব্র তার গতি যে, আশপাশ ঝাপসা হয়ে আসে যেন৷ দৌড় দৌড় আর দৌড়, একবিন্দু অবসর নেই কারও৷ ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত আধুনিক মানুষ একসময় উপলব্ধি করে, পায়ের নিচে ঘাসের মাথায় উজ্জ্বল মুক্তোর মতো ঝলমল করছে যে শিশিরবিন্দু, তাকে দেখাই হয়নি এতদিন। সবুজ গাছ, সেই গাছের কোটের বাসা বাঁধা পাখি, প্রতিদিনের চলার পথের আশ্চর্য সব দৃশ্য, চেনা জানলায় রোদের এসে পড়া- তার চৌকো বা তেকোণা গড়ন- সব কিছু রয়ে গিয়েছে দৃষ্টির অন্তরালে।
মিনিমালিজম মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির মধ্যে ভেঙে যাওয়া সেতুটা গড়তে চাইছে।
আধুনিক মনোবিজ্ঞানীরা কিন্তু বলছেন, জীবনভর এমন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটা একেবারেই কাজের কথা নয়। কমিয়ে আনুন জীবনের গতি৷ বরং বেছে নিন শান্ত জীবন৷ একটু চোখ তুলে থাকান চারপাশে৷ নিজের ঘরটাকেই দেখুন আরেকটু নজর দিয়ে৷ পিঁপড়ের গুটিগুটি চলন, মেঘেদের খুনসুটি, গাছ থেকে গাছে উড়ে বেড়ানো প্রজাপতি বা নিছক হাওয়ায় পাতার দুলে ওঠার মধ্যেও খুঁজে পাবেন আশ্চর্য আনন্দ। অনেকখানি ভর্তি মনে হবে নিজেকে। ভালো থাকবেন।
'মাইন্ডফুলনেস মুভমেন্টে'র অন্যতম পথিকৃৎ জোন কাবাট-জিন বলছেন, যাঁরা গতিমন্থর জীবনকে আপন করে নিতে পেরেছেন, তাঁরা অনুভব করছেন প্রতিটি মুহূর্তই অনন্য। সময় থেমে থাকছে তাঁদের কাছে। মাছ ধরতে বসা মানুষটি যেমন নিবিড়ভাবে চেয়ে থাকেন ফাতনার দিকে, ঠিক তেমন একাগ্রতায় তাঁরা বেঁচে নিচ্ছেন জীবন। প্রতিটি দিনকে তাঁরা নতুন করে আবিষ্কার করছে। খুঁজে পাচ্ছেন শান্তি।
'দেরি করে ফেলা' বা বড় কিছু মিস করে ফেলার ভয়, যাকে বলে ফোমো- FEAR OF MISSING OUT থেকে মুক্তি পাওয়া কিন্তু খুব সহজ কথা নয়। আধুনিক মনোবিজ্ঞান বলছেন, যাঁরা এই গতিময় জীবনের দৌড়ের ট্র্যাক থেকে নিজেদের সরিয়ে আনতে পারেন, তাঁরা অনেক বেশি ভালো রাখতে পারেন নিজেকে। বড্ড ব্যস্ত এই সময়ে কাজটা কঠিন, ভীষণ কঠিন, কিন্তু চেষ্টা করে দেখবেন নাকি?