পুজো এসে গেছে! এই তিনটে শব্দ পাশাপাশি বসলে যে ব্যাঞ্জনা তৈরি করে, পৃথিবীর আর কটা শব্দে সেই আবেগ জড়িয়ে থাকে, হাতে গুনে বলা যায়! বছরের সেই সময়টা এসে গেছে, যখন এই তিনটে শব্দ বলা যায় বারবার। পাঁচটা দিনের উৎসবের গল্প, জাঁকজমকের কথা সারা বিশ্ব যতটা জানে, তার আড়ালে চলা বিশাল কর্মকাণ্ডের কথা বরং অজানাই অনেকটা। কুমোরটুলিতে ভয়ানক ব্যস্ততা এখন। যাকে ঘিরে মানুষের বছরভরের প্রতীক্ষা, এত আয়োজন, সেই দেবী দুর্গার জন্মকথা রচিত হচ্ছে এখানে।
শিল্পীদের হাতে গড়ে উঠছে প্রতিমা। একেবারে শেষ স্তরের মাটির প্রলেপ পড়ছে কোথাও, কোথাও শুরু হয়েছে রং। ত্রিপল টাঙানো খোপগুলোয় আঁধার, অথচ ওই অন্ধকার খোপেই চলছে আলোর প্রস্তুতি। প্রতিটা ঘর যেন আঁতুড় ঘর। সন্তানের জন্ম হচ্ছে শিল্পীদের হাতে। দীর্ঘ প্রসব যন্ত্রণার জন্য শেষ কয়েক মাস ধরে নিজেদের তৈরি করেছেন শিল্পীরা।
Viswakarma Puja:Editorji Exclusive: আকাশজোড়া ঘুড়ি কি শুধুই বিশ্বকর্মা পুজোর বিকেলের জন্যেই রাখা?
বায়না হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। এখন চলছে শেষ মূহুর্তের প্রস্তুতি। গোটা কুমোরটুলি জুড়ে ব্যস্ততার অন্ত নেই। দিনরাত এক করে কাজ করে চলেছেন মৃৎশিল্পীরা। নাওয়াখাওয়ার সময় নেই তাঁদের। তার মধ্যেই উড়ে এসে জুড়ে বসেছে নিম্নচাপ৷ আচমকা প্রবল বৃষ্টিতে কিছুটা হলেও ক্ষতি হয়েছে কাজের। কিন্তু তার জন্য দেরি করার উপায় নেই৷ ঠিক সময়ে মণ্ডপে পৌঁছে দিতেই হবে প্রতিমা। তাই কাজ চলছে পুরোদমে।
শহরের নানা বড় বড় ক্লাবের পুজোর প্রতিমা গড়ার কাজ যেমন চলে এখানে, তেমনই বাড়ির পুজো, তুলনামূলক কম নামি পুজোর বরাতও আসছে দিনরাত। শিল্পীর জাঁকজমক দিয়ে তাঁদের শিল্পকে ভাগ করেন না। দেবী দুর্গা থেকে মহিষাসুর সবাইকে গড়তেই স্রষ্টার একই রকম নিষ্ঠা।
মায়ের পুজোয় ভারী ব্যস্ততা আরেক মায়ের, বড় রাস্তার ওপর এক চিলতে দোকান, তারই মধ্যে কোনোরকমে বসেছেন, কাগজ-কাচি নিয়ে এক মনে- বানিয়ে চলেছেন দেবীর মুকুটের নানা অংশ।
অতিমারী পেরিয়ে এ বছর খানিকটা স্বস্তি! তাই বায়নাও কিছুটা বেশি। তবে মূল্যবৃদ্ধির জেরে লাভের পরিমাণ নিয়ে রয়েছে অসন্তোষ, কিন্তু কাজে ফাঁকি নেই শিল্পীদের।
রাজকুমার পাল, শঙ্কর পাল, কয়েকটা নাম, কোনও কোনও মণ্ডপের একপাশে লেখা থাকবে এরকম কতশত শিল্পীর নাম, কোথাওবা লেখা থাকবে না। ইতিহাসে এই সব নামেরা লেখা থাকে না কোনও দিন। অথচ একতাল মাটিকে নিয়ে যাদু করে চলেছে এক একটা হাত, কত শত বছর ধরে।
প্রতিমাদের আঁতুড়ঘরে আলো নেই, ওদের পরিবারের কাছে পুজো মানে অনেকটা ব্যস্ততা, আর একটু আশা, বছরভরের একটু নিশ্চিন্তি। কুমোরটুলির এঁদো গলির এক খুপরি থেকে আরেক খুপরি যেতে যেতে মনে পড়ে রবি ঠাকুরের সেই শব্দগুলো,
মানুষই দেবতা গড়ে, তাহারই কৃপার পরে করে দেব মহিমা নির্ভর'।