লখনৌ শহর। একদিকে ইতিহাস জীবন্ত হয়ে উঠছে, অন্যদিকে আবার অলি-গলি থেকে রাজপথ, কোথাও কাবাবের গন্ধ ম ম, কোথাও গরম গরম বিরিয়ানি থেকে ধোঁয়া উঠছে, কিম্বা মন গলিয়ে দিচ্ছে স্পেশাল মাখন মালাই। নবাবের শহরের মেহমান বলে কথা! শুকনো মুখে ঘুরলে হয়। শহরের প্রতি রাস্তায় দাওয়াত-এ-ইশক।
লখনৌর সকাল শুরু হল লালবাগের চা দিয়ে। প্রায় ৭০ বছরের পুরনো শর্মাজি কি চায়। ধোঁয়া ওঠা চায়ের ভাড়, সঙ্গে বান মাসকা। কিছু বাদ পড়ল? বাঙালি সিঙ্গারার ভক্তকে অবাঙ্গালি সমোসার প্রেমে হাবুডুবু খেতে বাধ্য করেছে ২০ টাকার এই সিঙ্গারা। আর তাকেই কিনা ভুলে যাচ্ছিলাম? তওবা তওবা! সকাল থেকে শর্মাজি কি চায়ের সামনে যানজট। লখনৌর ঘুম ভাঙছে যে। কেউ একাই চার চুমুকে শেষ করে ফেলছেন চল্লিশ টাকার চা। কেউ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছেন দুধ-সাদা মাখন মাখানো বান।
একটু ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত। একটু বিরিয়ানি হবে নাকি? আরে, গোটা এক প্লেট না পারলে হাফ প্লেট? হয়েই যাক। পৌঁছে গেলাম রাজাবাজার চকের ইদ্রিস বিরিয়ানিতে। ঝাঁ চকচকে রেস্তোরাঁর রেশ মাত্র নেই। হাইজিন নিয়ে খুব মাথা ব্যথা থাকলে অনেকেই ইদ্রিসে যাওয়ার আগে দুবার ভাববেন, কিন্তু, লখনৌ-এর বিরিয়ানির আসল স্বাদ থেকে বঞ্চিত থেকে যাবেন ইদ্রিসের মাটন বিরিয়ানি আর চিকেন কোর্মা না খেলে। ছোট ছোট স্টিলের থালায় এরা পরিবেশন করে হাফ প্লেট বিরিয়ানি। আহা! বসে খাওয়ার জায়গায় ঠেলাঠেলি করে বসতে হবে। কনুইয়ে ঠোকাঠুকি হবে। এর গায়ের ঘাম ওর গায়ে লাগবে। তবেই ইদ্রিস আসা সার্থক।
ইদ্রিস ছাড়া অওয়ধ বিরিয়ানির স্বাদ আর কোথায় কোথায় পাবেন। যেতে পারেন দস্তরখানের যে কোনও শাখায়। অথবা চকের কাছেই মুবিনে। লাল্লা বিরিয়ানির স্বাদও দুর্ধর্ষ। কলকাতায় হালে নানা স্বাদের বিরিয়ানি জনপ্রিয় হলেও, কলকাতায় বিরিয়ানির প্রচলন করেছিলেন আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে, নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। সালটা ১৮৫৬। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নির্দেশে প্রাণের চেয়েও প্রিয় লখনৌ ছেড়ে কলকাতায় চলে এলেন অওয়ধের শেষ নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ। তিনি লখনৌ ছাড়লেন ঠিকই, কিন্তু লখনৌ তো ছাড়ল না তাঁকে। এখানে ছোট লখনৌ তৈরি করলেন নবাব। তৈরি করলেন প্রাসাদ, বাগিচা, চিড়িয়াখানা। শুরু হল ঘুড়ি ওড়ানো, কবুতরবাজি। আর চালু হল বিরিয়ানি রান্না। নবাবের রসনা তৃপ্তির জন্যই এ শহরে ‘দমপোখ্ত’ বা ঢিমে আঁচে রান্না শুরু হয়। অনেকে বলেন, বিরিয়ানিতে আলুর প্রচলনও নাকি তাঁরই। ওয়াজেদ আলি শাহ যখন কলকাতায় আসেন, তখন তাঁর কাছে তেমন অর্থ ছিল না ৷ কিন্তু বিরিয়ানি তো রান্না হওয়া চাই-ই চাই। তাই মাংসের পাশাপাশি ব্যবহার শুরু হল আলুর৷
খাবার থেকে ঢুকে পড়েছিলাম নবাবি গল্পে। এবার নবাব থেকে ফিরি কাবাবে। লখনৌ আর কাবাব, এই দুটো শব্দ পাশাপাশি বসলেই অটো আপনাকে সোজা নামাবে তুন্ডে কাবাবির দরজায়। এখানে একবার এলেই মন গলে জল নয়, তুন্ডে কাবাব! মুখে পুরলেই কী এক যাদুবলে গলে যাবে কাবাব। তাই তো ওদের ট্যাগলাইন 'মেল্ট ইন মাউথ'।
নোনতা ঝাল অনেক তো হল? এবার, কুছ মিঠা হো যায়ে? ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে লখনৌ গেলে উপড়ি পাওনা মাখন মালাই।
মাখন মালাইকে লখনৌতে ডাকা হয় নিমিষ নামেও। স্বর্গীয় স্বাদের মিষ্টি বটে। ফেনার মতো মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়। বারাণসীতে এরই নাম 'মালাইও'। দিল্লিতে নাম দৌলত কা চাট! এই মিষ্টির বৈশিষ্ট্য কী? মোষের দুধ ঘন করে জাল দিয়ে মাখন আর ক্রিম মিশিয়ে সারা রাত মশারিতে বিছিয়ে, খোলা আকাশে রাখা হয়, শীতের কুয়াশাটা ওই নিমিষের ওপর পড়লে তৈরি হয় পারফেক্ট মালাইয়ো। ভোর থেকে দুপুর দুপুর পর্যন্ত পাওয়া যায় মাখন মালাই। বছরের এই সময়টায় একমাত্র লখনৌতে আর একটা মিষ্টি পাওয়া যায়। কালি গাজর কা হালুয়া। বলতে গিয়েই জিভে জল আসছে।
হজরতগঞ্জের রাস্তায় যখন সূর্য ঢলে পড়ছে, গজলের মতো সন্ধ্যে নামছে, আপনার পেট ততক্ষণে খালি খালি লাগছে। কারণ, আপনি দাঁড়িয়ে লখনৌর জনপ্রিয় রয়াল ক্যাফের বাইরে। বাস্কেট চাট, পালক চাট, মটর টিক্কি চাটের হাতছানি উপেক্ষা করা যায়? খানেওয়ালো কো খানেকা বাহানা চাহিয়ে। এবার চাট চেখে দেখার পর, আর রাতের খাবার খাওয়ার আগে দিল খুশ করে দিতে পারে প্রকাশের কুলফি!
মনও ভরেছে, সঙ্গে পেট তো বটেই, তাহলে কিচ্ছু আর বাকি কি নেই? নবাব-বাদশাহর শহর। দিল যেমন নবাবি, দাওয়াতের আয়োজনও এলাহি। তাই বাদ থেকে গেল অনেক কিছু। যেমন রহিমের কুলচা-নিহারি, দস্তরখানের শিরমল, রাম আশ্রের মালাই পান, পন্ডিত রাজার ঠান্ডাই, এ যাত্রায় হলো না? এক যাত্রায় সব স্বাদ পেতেও নেই, কিছুটা বাকি থাক। এ সবের টানেই তো ফের আসা যায় এই শহরে।