লখনৌ বললেই যে আইকনিক স্থাপত্যের কথা চোখে ভাসে, সেটা হলো ভুলভুলাইয়া। আড়াইশ বছর আগের এই স্থাপত্যকে ছাড়া লখনৌ সফর শুরুই হয়না। আমাদেরও নবাবের শহর দেখা শুরু হলো ভুলভুলাইয়া দিয়েই। মাচ্ছি ভবনের উলটো দিকেই ভুলভুলাইয়ার বিশাল রাজকীয় ফটক, নহবত খানা নামেও চেনেন অনেকে। ফটক দিয়ে ঢুকেই বিশাল মসজিদ, আর সোজাসুজি বড়া ইমামবড়া। ওমা! তাহলে ভুলভুলাইয়া কই? বিশাল নবাবি স্থাপত্যের নিচের তলায় ইমামবড়া, আর ওপরে ভুলভুলাইয়া।
বেশিরভাগ বাঙালির প্রথম লখনৌ দেখা ফেলুদার চোখ দিয়ে, থুড়ি তোপসের চোখ দিয়ে। তাই লখনৌর টিকিট কাটার পরই বুক শেল্ফ থেকে নামিয়ে নিয়েছিলাম 'বাদশাহি আংটি'! স্কুল জীবনে পড়া গল্প আবার গোগ্রাসে পড়ে ফেলে, কলেজ জীবনে দেখা সিনেমা আবার দেখে ফেলে, অডিওতে গোটা গল্প শুনে ফেলে যখন চারবাগ স্টেশনে পা রাখলাম, তখন মনে হল, এ শহর তো আমার হাতের মুঠোয়। লালবাগ, কাইজারবাগ, হজরতগঞ্জ দিয়েই তো কত শতবার হেঁটে গেছি শেষ ক'দিনে। লখনৌ-এর আগের নাম যে লক্ষণাবতী, সেও ফেলুদার গল্প থেকেই জানা। রামায়ণে লক্ষণের রাজধানী হিসেবে বর্ননা করা হয়েছে এই শহরকে। ছোটা ইমামবড়ার কাছে একটি টিলা এখনও লক্ষ্মণ টিলা নামে পরিচিত।
হোটেলে মালপত্তর রেখে সামান্য জিরিয়েই চলে গেলাম ভুলভুলাইয়া চত্ত্বরে। টিকিট কেটে ভেতরে ঢোকার আগে শরীরে মনে নবাবিয়ানা আনতে একটু টাঙ্গায় না চড়লেই নয়।
১৭৮৪ সালে ভুলভুলাইয়া বা বড়া ইমামবড়া তৈরি করেছিলেন লখনৌয়ের নবাব আসিফ উদ দৌলা। সিংহাসনে বসার পরেই নবাব অবধের রাজধানী ফৈজাবাদ থেকে নিয়ে এলেন লখনৌতে।
এগারো বছর লেগেছিল বড়া ইমামবড়া তৈরি হতে। এত বছর কেন লাগল? এই নিয়ে এক আশ্চর্য গল্প প্রচলিত রয়েছে। আসিফ উদ দৌলার আমলে নাকি বড় একটা দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, মানুষের হাতে কাজ ছিল না। সেই সময় কর্ম সংস্থান বাড়াতে বড়া ইমামবড়া নির্মাণের নির্দশ দিলেন নবাব। দিনে শুরু হল ইমামবড়া নির্মাণের কাজ। এবার সমাজে যারা একটু উচ্চবিত্ত, তাঁরা ইমামবড়া বানাতে জানতেন না, তাহলে তাঁরা কী করবেন? দিনে যে অংশটা তৈরি হতো, রাতে সেই অংশই ভাঙতেন উচ্চবিত্তরা। এভাবে ইমামবড়া একটু করে তৈরি হতো, আবার রাতে ভাঙ্গা হতো। তাই তো ইমামবড়া বানাতে সময় লেগেছিল ১১ বছর।
বাহারের দিক থেকে বড়া ইমামবড়া মুঘল প্রসাদের ধারেকাছে না আসলেও আকারে একে টেক্কা দিতে পারেনি কেউ। এর মতো বড় দরবার হল নাকি গোটা দুনিয়ায় একটাও নেই। ইমামবড়ার ওপরের তিন তলাজুড়ে ভুলভুলাইয়া। আর ভুলভুলাইয়া যে কেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যে নেই, সে প্রশ্ন তো ভুলভুলাইয়া গেলে, মনে জাগবেই। ভুলভুলাইয়ায় ঢোকার নাকি প্রায় ৫০০ খানা দরজা, ১০০০টা বারান্দা, সব দরজা আবার একই রকম দেখতে। অথচ ফেরার সঠিক পথ একটাই। গাইড ছাড়া একা ভুলভুলাইয়া নামক গোলকধাঁধার বাইরে বেরনো প্রায় অসম্ভব। এই ভুলভুলাইয়ায় নাকি নবাবরা তাঁদের বেগমদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতেন। ১৬ ফুট পুরু দেওয়ালের মাঝে আড়াই ফুট সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। সেই পুরু দেওয়াল ভেদ করে সব শব্দ শোনা যায় দেওয়ালের অন্য পাশে। কীভাবে সম্ভব? উত্তর এখনও অজানা। ফিসফিস করে বলা কথা এমন কী দেশলাই কাঠি জ্বালানোর আওয়াজ পর্যন্ত শোনা যায় ওই অত মোটা দেওয়ালের অন্য পাশে।
রইল পড়ে, রুমি দরজা। একদিক থেকে দেখতে চারতলা, অন্যদিক থেকে দেখলে মনে হবে একতলা। এই রুমি দরজার দিয়ে যাতায়াত করাকে বড় গর্বের বলে মনে করেন এই শহরের মানুষ।
এত তথ্যে বোঝাই হয়ে গেলে শহরের গল্প ভারী হয়ে যায়। কিন্তু লখনৌকে বুঝতে এত তথ্য মনে না রাখলেও চলে। একটু অন্য গল্প বলি? ধর্মের নামে হিংসা, হানাহানির সময়ে দাঁড়িয়ে মন ভাল করে দেওয়া একটা গল্প। নবাবের শহরে হোলি খেলার গল্প। নবাব আসিফ উদ দৌলা নাকি মহা ধূমধাম করে হোলি খেলতেন, গোটা শহরর সব ধর্মের মানুষ রঙের উৎসবে শামিল হতেন আড়াইশ বছর আগে।
লখনৌ শহরে মহরম চলে দু'মাস ধরে। মহরম তো আসলে শোকযাপন। ওয়াজিদ আলি শাহের রাজত্বকালে একবার মহরম আর হোলি, একই সময় পড়েছে। একই সঙ্গে শোক আর আনন্দ উদযাপন হবে কীভাবে? নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ ঠিক করলেন দিনভর রং খেলবে লখনৌবাসী, সূর্যাস্তের পর মহরম পালন করা হবে। সেই সময় থেকেই মহরমে অংশ নেন এই শহরের হিন্দুরাও।
কাউকে ফেরায় না এই শহর। মেহমানকে তো নাই। এই শহরের মেহমান নওয়াজি এমনই, লখনৌকে ভালবেসে ফেলা যায় এক বেলাতেই। আমাদের হাতে একবেলার চেয়ে সময় একটু বেশিই। তাই আমরা লখনৌকে ভালবাসব একটু একটু করে। হাতে সময় অনন্ত নেই, একদিন ফিরতেই হবে এই শহর ছেড়ে। আজকের মতো যেতে যেতে রেখে গেলাম একটা শায়েরি।
"আয়ে হো লখনৌ, তো থোড়াসা লখনৌ লেকড় যানা
চাহে এলাহাবাদ ইয়া, বেনারস কো জানা
গোমতী কি শাম, গঙ্গা কো জরুর বতানা
অউর ফির মুসখুরানা
দিল না লাগে ওয়হাপর, তো ফিরসে লখনৌ চলে আনা"।