'এই রোকো, পৃথিবীর গাড়িটা থামাও... এ গাড়ি যাবে না আমি অন্য গাড়ি নেব..'- কতদিন আগে লিখেছিলেন কিংবদন্তি সলিল চৌধুরী। তারপর কত বছর কেটে গিয়েছে, 'পৃথিবীর গাড়ি' তার গতি ক্রমাগত বাড়িয়েছে। এমনই তীব্র তার গতি যে, আশপাশ ঝাপসা হয়ে আসে যেন৷ দৌড় দৌড় আর দৌড়, একবিন্দু অবসর নেই কারও৷ ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত আধুনিক মানুষ একসময় কবির মতোই উপলব্ধি করে, পায়ের নিচে ঘাসের মাথায় উজ্জ্বল মুক্তোর মতো ঝলমল করছে যে শিশিরবিন্দু, তাকে দেখাই হয়নি এতদিন। সবুজ গাছ, সেই গাছের কোটের বাসা বাঁধা পাখি, প্রতিদিনের চলার পথের আশ্চর্য সব দৃশ্য, চেনা জানলায় রোদের এসে পড়া- তার চৌকো বা তেকোণা গড়ন- সব কিছু রয়ে গিয়েছে দৃষ্টির অন্তরালে।
আধুনিক মনোবিজ্ঞানীরা কিন্তু বলছেন, জীবনভর এমন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটা একেবারেই কাজের কথা নয়। কমিয়ে আনুন জীবনের গতি৷ উসেইন বোল্ট হতেই হবে, এমন মাথার দিব্যি আপনাকে কেউ দেয়নি৷ তার চেয়ে বরং বেছে নিন রাহুল দ্রাবিড়ের ব্যাটিংয়ের মতো শান্ত, গোছানে জীবন৷ একটু চোখ তুলে থাকান চারপাশে৷ নিজের ঘরটাকেই দেখুন আরেকটু নজর দিয়ে৷ পিঁপড়ের গুটিগুটি চলন, মেঘেদের খুনসুটি, গাছ থেকে গাছে উড়ে বেড়ানো প্রজাপতি বা নিছক হাওয়ায় পাতার দুলে ওঠার মধ্যেও খুঁজে পাবেন আশ্চর্য আনন্দ। অনেকখানি ভর্তি মনে হবে নিজেকে। ভালো থাকবেন।
আমাদের দেশে সাইকেল লেন বড়ই দুর্লভ৷ কিন্তু প্রথম বিশ্বের অনেকেই সাইকেল নিয়ে অফিসে যান। আগে যখন গাড়ি চালিয়ে যেতেন, তখন সময় বাঁচত বটে, কিন্তু মিস হয়ে যেত রাস্তার দুধারের পুরনো বাড়ি, গাছ, একটি দোকানে বসে তন্ময় হয়ে বই পড়া বৃদ্ধার মুখ, গাছ ও বাড়ির মাঝখানে ঝুলন্ত একখণ্ড আকাশ, অথবা এমন অনেক কিছু। আধুনিক 'মাইন্ডফুলনেস মুভমেন্টে'র অন্যতম পথিকৃৎ জোন কাবাট-জিন বলছেন, যাঁরা গতিমন্থর জীবনকে আপন করে নিতে পেরেছেন, তাঁরা অনুভব করছেন প্রতিটি মুহূর্তই অনন্য। সময় থেমে থাকছে তাঁদের কাছে। মাছ ধরতে বসা মানুষটি যেমন নিবিড়ভাবে চেয়ে থাকেন ফাতনার দিকে, ঠিক তেমন একাগ্রতায় তাঁরা বেঁচে নিচ্ছেন জীবন। প্রতিটি দিনকে তাঁরা নতুন করে আবিষ্কার করছে। খুঁজে পাচ্ছেন শান্তি।
সন্ত্রাসবাদী হামলায় গিল হিকস এক নারী পা হারিয়েছেন৷ হাঁটতে পারেন না৷ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে তিনি বলেছেন, এই অভিজ্ঞতা তাঁকে এক নতুন মানুষে পরিণত করেছে৷ যন্ত্রণা সত্ত্বেও তিনি অনুভব করেছেন জীবন সুন্দর৷ কারণ তিনি বাধ্য হয়েছে গতিমন্থর জীবনযাপন করতে৷ এর ফলে তিনি অনেক বেশি সময় কাটাতে পারছেন নিজের সঙ্গে। সময় তাঁকে আগে যেমন তাড়া করে ফিরত, তা হচ্ছে না আর।
যারা নিয়মিত ধ্যান করেন, তাঁদের তাড়া করতে পারে না সময়৷ 'দেরি করে ফেলা'র ভয় থেকে মুক্তি পাওয়া কিন্তু খুব সহজ কথা নয়। আধুনিক মনোবিজ্ঞান বলছেন, যাঁরা এই গতিময় জীবনের দৌড়ের ট্র্যাক থেকে নিজেদের সরিয়ে আনতে পারেন, তাঁরা অনেক বেশি ভালো রাখতে পারেন নিজেকে। বড্ড ব্যস্ত এই সময়ে কাজটা কঠিন, ভীষণ কঠিন, কিন্তু চেষ্টা করে দেখবেন নাকি?