'রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,/ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম..'। রথযাত্রার আগে সেজে উঠেছে পুরী। লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম হয়েছে প্রতি বছরের মতো৷ শুধু ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই নয়, বিশ্বের নানা দেশ থেকে ভক্তরা ভিড় জমিয়েছেন পুরীতে৷ তাঁদের একটিই স্বপ্ন, জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার রথের রশি স্পর্শ করবেন।
এই রথযাত্রার ইতিহাস নিয়ে রয়েছে আশ্চর্য সব গল্প৷ কিছু গল্প তো ভীষণ মজার৷ উল্টোরথের দিন যে জগন্নাথদেব বাড়ি ফেরেন, সে তো আমরা সকলেই জানি৷ কিন্তু জানেন কি বাড়ি ফেরার পর কেন তিন ভাইবোন জগন্নাথ, সুভদ্রা এবং বলরামদেব মন্দিরে প্রবেশ করতে পারেন না? এর নেপথ্যে রয়েছে দেবী লক্ষ্মীর রাগ। অথবা অভিমান।
কিন্তু কেন রাগ করেছিলেন দেবী লক্ষ্মী? পুরান অনুযায়ী এর নেপথ্য রয়েছে একটি ভারী সুন্দর গল্প। দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রার সঙ্গে রথে করে মাসির বাড়ি যাওয়ার আগের দিন জগন্নাথদেব তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মীকে কথা দিয়েছিলেন, তিনি মোটেই দেরি করবেন না। পরের দিনই ফিরে আসবেন। কিন্তু চার দিন কেটে যাওয়ার পরেও পরেও তিনি না ফিরলে স্বামীর বিরহে উতলা হয়ে ওঠেন লক্ষ্মী। জগন্নাথদেব কেমন আছেন, সেই চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে ছটফট করতে থাকেন মহালক্ষ্মী। অবশেষে পাঁচ দিনের দিন দেবী বিমলার পরামর্শে জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি গুণ্ডিচা মন্দিরে পালকি করে উপস্থিত হন তিনি। কিন্তু মহালক্ষ্মী আসছেন জানতে পেরেই গুণ্ডিচা মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দেন জগন্নাথ। এমন কষ্ট করে আসার পর স্বামীর এমন আচরণ! জগন্নাথদেবের উপর মহালক্ষ্মী অত্যন্ত রেগে যান।
তাঁকে ভুলে গিয়ে জগন্নাথ মহানন্দে দাদা ও বোনের সঙ্গে সুখে দিন কাটাচ্ছেন বুঝতে পেরে ভীষণ অভিমান ও রাগ হয় মহালক্ষ্মীর। রাগের চোটে অনুচরদের নির্দেশ দিয়ে জগন্নাথের রথ নান্দীঘোষের কিছুটা অংশ ভেঙে দেন তিনি। যদিও তারপরেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে মূল রাস্তা দিয়ে না ফিরে অন্য একটি ভেতরের রাস্তা দিয়ে একা ফিরে আসেন৷ এই আশ্চর্য সুন্দর রোম্যান্টিক গল্পটি যুগ যুগ ধরে ভক্তদের হৃদয়ে বিরাজ করছে। এই ঘটনাটি রথভঙ্গ নামে পরিচিত।
সপ্তাহখানেক মাসির বাড়িতে কাটিয়ে জগন্নাথ ফিরে এলেও লক্ষ্মীর অভিমান কমেনি। স্ত্রী রাগ করে থাকলে ঘরে ঢোকার সাধ্য থাকে কোন স্বামীর? সে তিনি যতই জগন্নাথদেব হোন না কেন! সেই কারণেই তিনদিন অপেক্ষা করতে হয় জগন্নাথকে৷ তাঁর সঙ্গেই অপেক্ষা করেন বলরাম ও সুভদ্রাও। স্বামীর কাছে স্ত্রীয়ের মানভঞ্জনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কী আছে? লক্ষ্মীর মান ভাঙাতে জগন্নাথ সঙ্গে নেন লক্ষ্মীর প্রিয় ভোগ- লক্ষ্মীবিলাস। দেবদেবীদের ভালোবাসাও যে সাধারণ মানুষের মতোই মান অভিমানের রসে টইটম্বুর, তার প্রমাণ এই কাহিনী।
রথযাত্রা নিয়ে আরও অসাধারণ সব গল্প রয়েছে পুরানে৷ ওড়িশার প্রাচীন পুঁথি ব্রহ্মাণ্ড পুরানে বলা হয়েছে, এই রথযাত্রা শুরু হয়েছে সত্যযুগে৷ রাজা ইন্দ্রদ্যুন্ম তৈরি জরেছিলেন বিষ্ণু মন্দির। সেখানে বলরাম, সুভদ্রা এবং জগন্নাথদেবের মূর্তি তৈরি করছিলেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা। কিন্তু বিগ্রহ নির্মাণকালে বিশ্বকর্মা অসন্তুষ্ট হন ইন্দ্রদ্যুন্মের আচরণে৷ মূর্তি নির্মাণ না করেই চলে যান তিনি।
পুরান অনুযায়ী, শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় তিথিতে দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রাকে দেখতে রথে চড়ে যান জগন্নাথদেব৷ সেই উপলক্ষ্যে ওই তিথি মেনে হয় রথযাত্রার আয়োজন৷ তার ৭ দিন পর হয় উল্টোরথ।
রথযাত্রার আগে জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত হয় স্নানযাত্রা। ১০৮টি সোনার ঘটিতে মন্দিরে উত্তর দিকের কূপ থেকে তোলা বিশুদ্ধ জলে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহকে স্নান করানো হয়। এরপর তিনদিন বন্ধ থাকে মন্দির৷ মনে করা হয়, জ্বরে আচ্ছন্ন হয়ে থাকেন তিন ভাইবোন।