বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বন, জীবন জুড়ে উৎসব, আর এ তো শুধু জীবন নয়, জামাই বাবা জীবন বলে কথা! বুঝতেই পারছেন, বলছি জামাই ষষ্ঠীর কথা।শুরুতে নাকি দিনটা ছিল সন্তানের মঙ্গল কামনায় ষষ্ঠী। তা বাঙালির জামাই প্রীতি সর্বজনবিদিত। তাই ষষ্ঠী হয়েছে জামাই ষষ্ঠী। সব কাজ ভুলে আম, লিচু নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে কবজি ডুবিয়ে খাওয়ার দিন। এই জামাই আদর নিয়ে কিন্তু ইতিহাসে লেখা আছে নানা গল্প, আজ রইল সেই সব অভিনব গল্প।
সূর্য মোদকের জলভরা সন্দেশের সঙ্গে জড়িয়ে আছে জামাই ষষ্ঠীর গল্প। ভদ্রেশ্বরের তেলিনীপাড়ার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার। জমিদার বাড়ির মেয়ে বাপের বাড়ি এসেছেন জামাইষষ্ঠী উপলক্ষে। তখন আবার জামাইঠকানো বা বউঠকানো বহু প্রথা চালু ছিল। সূর্যকুমার মোদকের কাছে মিষ্টি তৈরির বরাত এল, জামাই ঠকানো মিষ্টি তৈরি রতে হবে। জামাই বিশাল সন্দেশ হাতে নিয়ে যেই না কামড় বসিয়েছে, মনি জল বেরিয়ে গরদের পাঞ্জাবিতে মাখামাখি। সেই থেকে জন্ম হল জলভরার।
ভারতীয় সিনেমার বাজারে বোম্বের ইম্পেরিয়াল মুভিটোন আর কলকাতার ম্যাডানের মধ্যে চাপা লড়াই ছিলই। হলিউডে ১৯২৮ এই টকি ছবি তৈরি হয়ে গেছে। ভারতেও তাই লড়াই শুরু হল ইতিহাস সৃষ্টির। মুভিটোন ১৯৩১ এর মার্চে সাত তাড়াতাড়ি রিলিজ করে দিল "আলম আরা"। ভারতের প্রথম টকি। । বাজারে টিকে থাকতে মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে ম্যাডানের হাত ধরে বাজারে এল প্রথম বাংলা টকি, ছবির নাম ‘জামাইষষ্ঠী’।
বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে প্রতি বছর উদযাপিত হয় জামাই মেলা। রসুলপুরসহ আশপাশের ৩০টি গ্রামের হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটে মেলায়। ব্রিটিশ আমলে বৈশাখী মেলা হিসেবে শুরু হলেও মেলা উপলক্ষে জামাইদের আপ্যায়ন করা হতো বলে এক সময় মেলাটি পরিচিতি পায় জামাই মেলা হিসেবে। দুই দিন ব্যাপী মেলার প্রথম দিনকে বলা হয় জামাই মেলা, আর দ্বিতীয় দিন বউ মেলা। মেলার সময় জামাইয়ের হাতে কিছু টাকা তুলে দেয় শাশুড়িরা। সেই টাকা দিয়ে জামাইয়ের কেনা মিষ্টি বিলি করা হয় আশপাশের বাড়িতে।
পশ্চিমবঙ্গের এই মন্দিরে জামাইষষ্ঠীর দিন জামাই-আপ্যায়ন করা হয় স্বয়ং শ্রী চৈতন্যকে। নবদ্বীপের মহাপ্রভু মন্দিরে চৈতন্য দেব এই দিন ভগবান হিসাবে নয়, বরং সকলের প্রিয় জামাই হিসাবে পূজিত হন। নিমাইকে জামাই আদর করেন বিষ্ণুপ্রিয়ার ভাইদের উত্তর পুরুষ। বিগত কয়েকশো বছর ধরে চলে আসছে এই রীতি।
এবার একটু বলা যাক সময়ের চেয়ে অনেকাংশে এগিয়ে থাকা বাংলার এক পরিবারের কথা। ঠাকুর পরিবার। ব্রাহ্ম ধর্মের উপাসক হওয়ায় জামাই আদরের তেমন বাড়াবাড়ি ঠাকুর পরিবারে ছিল না। স্বর্ণকুমারীর স্বামী জানকীনাথকে বিলেতে থাকাকালীন তেতোর অভাবে কুইনাইন দিয়ে শুক্তুনি রেঁধেছিলেন ঠাকুর বাড়ির এই মেয়ে! দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেজ মেয়ে শরৎকুমারীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল যদুনাথ মুখোপাধ্যায়ের। ছোট থেকেই যদুনাথের ঠাকুরবাড়িতে যাতায়াত ও মেলামেশা ছিল।বিয়ের পরও শরৎকুমারী স্বামীকে নাম ধরে ‘যদু’ ডাকতেন।
অনেকেই বলেন জামাই ষষ্ঠী আসলে 'পিতৃতান্ত্রিক' সমাজের উৎসব। সমাজে লিঙ্গসাম্য থাকলে বিয়ের পর নিজের বাড়ি ছেড়ে স্বামীর বাড়িতে সংসার করার চল থাকত না কয়েকশ বছর ধরে। তবে, এখন উল্টোটাও আকছার হচ্ছে। চিনের নানা ম্যাট্রিমনি সংস্থায় 'পাত্র চাই'এর বিজ্ঞাপনেও ঘরজামাইদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। বিয়ের পর সন্তান বাবা নয়, মায়ের পদবী জুড়ছে নামের সঙ্গে।