'তোমাদের মায়ের কাছ থেকে আমি বিচ্ছেদ মানে ডিভোর্স চাইছি...'
'বেলাশেষে' সিনেমায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মুখে শোনা গিয়েছিল এই বিখ্যাত ডায়লগ । সিনেমায় দেখানো হয়েছিল, ৪০-৫০টা বছর হাতে হাত রেখে সুখে-দুঃখে জীবন কাটিয়ে দেওয়ার পর, জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে স্ত্রীর (স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত) থেকে বিচ্ছেদ চাইছেন স্বামী (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) । দীর্ঘদিন একসঙ্গে সংসার সবটাই কি শুধু অভ্যাস, প্রেম কি নেই ? সম্পর্কের এই জটিলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল 'বেলাশেষে' । শুধু সিনেমা নয়, এমন ডিভোর্স কিন্তু বাস্তবেও হয় । যাকে বলা হচ্ছে গ্রে ডিভোর্স । সিলভার স্প্লিটার বলা হয় । তবে গ্রে ডিভোর্স বর্তমানে ভীষণভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ডিং ।
দিন যত এগোচ্ছে, গ্রে ডিভোর্সের সংখ্যা নাকি বাড়ছে বিশ্বজুড়ে । ভারতেও এমন উদাহরণ প্রচুর । সম্প্রতি যেমন, ২৯ বছর একসঙ্গে থাকার পর বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘোষণা করেছেন এ আর রহমান ও সায়রা বানু । এই বিচ্ছেদকেও গ্রে ডিভোর্সের পর্যায়ে ফেলেছেন বিশেষজ্ঞরা । কিন্তু এই গ্রে ডিভোর্স কী ? কেন ট্রেন্ড বাড়ছে এই ধরনের ডিভোর্সের ? জেনে নেওয়া যাক বিশদে
গ্রে ডিভোর্স
গ্রে মানে ধূসর । ডিভোর্স মানে বিচ্ছেদ । মানেটা কেমন দাঁড়াল ? ধূসর ডিভোর্স ? প্রেমের রং যেমন লাল, গোলাপি, তেমনই বিচ্ছেদের রং-ও কি ধূসর ? ঠিক তা নয় । তবে,বিচ্ছেদ তো সত্যিই মনের সেই প্রেমের রং-কে ফিকে করে দেয়, ধূসর একটা প্রলেপ পড়ে । যদিও গ্রে ডিভোর্সের অর্থ তা নয় ।
গ্রে ডিভোর্স মানে হল দীর্ঘ দাম্পত্যজীবন পেরিয়ে যাঁরা বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন । তা ১৫ বা ২০ বছর হতে পারে কিংবা ৩০ বছর বা তার বেশি । মূলত,পরিণত বয়সে বিবাহ-বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তকেই বলছে গ্রে ডিভোর্স । সাধারণত, ৫০-এর আশেপাশে বা তার বেশি বয়সী দম্পতিদের বিচ্ছেদকে বলা হয় গ্রে ডিভোর্স । এটা কি নতুন ট্রেন্ড নাকি আগেও ছিল গ্রে ডিভোর্স ?
গ্রে ডিভোর্সের ইতিহাস
নথিপত্র অনুসারে, আমেরিকাতে গ্রে-ডিভোর্সের উদাহরণ রয়েছে আশির দশকে । কিন্তু ২০০৪ সালের আগে এ বিষয়ে তেমন একটা চর্চা ছিল না । ওই বছরের একটা গবেষণাপত্র থেকে এ বিষয়ে অবগত হতে শুরু করেন মানুষ । পরে ২০০৭ সালে ডেইড্রে বেয়ারের লেখা 'কলিং ইট কুইটস' বইটি গ্রে ডিভোর্সের বিষয়টিকে আরও প্রচারের আলোয় নিয়ে আসে । ওই বইতে এমন কিছু মানুষের সাক্ষাৎকার রয়েছে, যাঁদের গ্রে ডিভোর্স হয় ।
ক্রমবর্ধমান গ্রে ডিভোর্স
১৯৭০-১৯৯০ : ৫০ বছরের বেশি বয়সীদের বিবাহ বিচ্ছেদের হার ছিল কম । ধীরে ধীরে তা বৃদ্ধি পেয়েছে । ১৯৭০ সালে যা ছিল
প্রতি ১০০০ বিবাহিতদের মধ্যে ৩.৬৯ শতাংশ । ১৯৯০ সালে তা বেড়ে হয়েছে প্রতি ১০০০ জনে ৪.৮৭ শতাংশ । ১৯৯০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ৫০ বছরের বেশি বয়সী মানুষদের ডিভোর্সের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুন হয়েছে । প্রতি ১০০০-এ ১০.০৫ শতাংশ । ২০১৯-এ সংখ্যাটা কমে হয়েছে প্রতি ১০০০ বিবাহিতদের ৯.৬৪ শতাংশ । এদিকে, ২০২৩ সালের হিসেব বলছে, আমেরিকাতে মোট ডিভোর্সের এক তৃতীয়াংশ ডিভোর্স হয়েছে ৫০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের ।
গ্রে ডিভোর্সের কারণ কী ?
গ্রে ডিভোর্স কেন বাড়ছে, মনোবিদদের আলোচনায় বেশ কিছু কারণ উঠে এসেছে
১. সম্পর্কের সুঁতো বেঁধে রাখেন সন্তানরা । বহু দম্পতির ক্ষেত্রেই তাই । কিন্তু, অনেক সময়ই দেখা যায়, সন্তান বড় হয়ে পড়াশোনা, চাকরি অথবা বিয়ের কারণে বাড়ির বাইরে চলে গেলে, সেই সুতো অনেকটা আলগা হয়ে যায় অনেকের কাছে । বিষণ্ণতা, অবসাদ ঘিরে ধরে । তখন তাঁদের পক্ষে একসঙ্গে একই ছাদের নিচে থাকাটা অসম্ভব বলে মনে হয় ।
২. অর্থ সংকটের কারণেও মনোমালিন্য হতে পারে
৩. একে অপরের প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া, দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য
৪. মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা একটা অন্যতম কারণ
৫. বেশি বয়সেও জীবনে নতুন করে আসতে পারে প্রেম । যাঁরা সুস্থ জীবন-যাপন করেন, যাঁরা জীবনকে নতুন করে উপভোগ করতে চান, তাঁদের ক্ষেত্রে গ্রে ডিভোর্সের প্রবণতা বাড়ে
ভারতেও গ্রে ডিভোর্সের প্রবণতা বাড়ছে । বলি-টলি তারকাদের মধ্যেও এই ডিভোর্সের ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে । গ্রে ডিভোর্সের তালিকায় রয়েছে কোন তারকারা, একনজরে দেখে নেওয়া যাক...
আমির খান-কিরণ রাও
২০২১ সালে ডিভোর্সের ঘোষণা করেন আমির খান-কিরণ রাও । ১৬ বছরের দাম্পত্যে ইতি টানেন তাঁরা । তবে, বিষয়টিকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখেছেন তাঁরা । আলাদা আলাদা থাকলেও, বন্ধুত্ব অটুট রয়েছে দু'জনের মধ্যে । ছেলেকে একসঙ্গে মানুষ করছেন আমির-কিরণ ।
হিমেশ রেশমিয়া-কোমল
সঙ্গীত শিল্পী হিমেশ রেশমিয়াও ২২ বছরের দাম্পত্যে ইতি টেনেছেন । ১৯৯৫ সালে কোমলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন হিমেশ । তাঁদের একটি পুত্র সন্তানও আছে । ২০১৭ সালে বিচ্ছেদের পথে হাঁটেন তাঁরা ।
ঊর্মিলা-মোহসিন মীর
এ আর রহমানের আগে লাইমলাইটে ছিল ঊর্মিলা মাতোন্ডকারের বিবাহবিচ্ছেদ । আট বছরের দাম্পত্যে ইতি টানেন তিনিও । ২০১৬ সালে ১০ বছরের ছোট মহসিন আখতার মীরকে বিয়ে করেন ঊর্মিলা । আট বছরের মাথাতেই ডিভোর্সের ঘোষণা । তবে তাঁদের বিচ্ছেদের কারণ এখনও জানা যায়নি ।
কমল হাসান-সারিকার ঠাকুর
২০ বছরের দাম্পত্যজীবন ছিল কমল হাসান-সারিকা ঠাকুরের । কিন্তু ২০০৪ সালে তাঁদেরও বিচ্ছেদ ঘটে ।
মালাইকা-আরবাজ
বলিপাড়ার অন্যতম চর্চিত জুটি ছিলেন মালাইকা-আরবাজ । তাঁদের ১৯ বছরের দাম্পত্যজীবনে ভাল-খারাপ সময়ে এসেছে । একসঙ্গে সবকিছুর মোকাবিলা করেছেন তাঁরা । তাঁদের একটি পুত্রসন্তানও রয়েছে । কিন্তু, ২০১৭ সালে তাঁদের বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে । যা অনুরাগীদের জন্য অবাক করেছিল । তবে, দু'জনেই এখন নিজেদের জীবনকে নিজের মতো করে গুছিয়ে নিয়েছেন । কয়েক মাস আগেই দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন আরবাজ । অন্যদিকে, অর্জুন কাপুরের সঙ্গে দীর্ঘদিন সম্পর্কে ছিলেন মালাইকা । সদ্য সেই সম্পর্ক ভেঙেছে ।
এ আর রহমান-সায়রা বানু
গ্রে ডিভোর্সের তালিকায় সদ্য নাম লিখিয়েছেন এ আর রহমান ও সায়রা বানু । ২৯ বছরের দাম্পত্যজীবনে ইতি ঘটিয়েছেন সম্প্রতি । কী কারণে ডিভোর্স এখনও জানা যায়নি । এদিকে, রহমানের পরই তাঁর টিমের বেসিস্ট মোহিনীর বিচ্ছেদের খবর প্রকাশ্যে আসতেই দুই ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র খুঁজছেন নেটিজেনরা । যদিও রহমানের আইনজীবী দাবি করেছেন, দুই ঘটনার মধ্যে কোনও যোগসূত্র নেই । উল্লেখ্য, তিন সন্তান রয়েছে রহমান-সায়রার
বিল গেটস-মেলিন্দা ফ্রেঞ্চ
বলিউড থেকে যদি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নজর রাখা যায়, তাহলে প্রথমেই উঠে আসবে মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের বিবাহ বিচ্ছেদের কাহিনী । ২০২১ সালের মে মাসে মেলিন্দার সঙ্গে ২৫ বছরের দাম্পত্যজীবনে ইতি ঘটিয়েছেন বিল ।
এছাড়া গ্রে ডিভোর্সের তালিকায় রয়েছে, ফারহান আখতার-অধুনা ভবানি, অর্জুন রামপাল মেহর জেসিয়া ও আরও অনেকে । সম্প্রতি আবার গ্রে ডিভোর্সের তালিকায় রাখা হচ্ছে অভিষেক ও ঐশ্বর্যকে । গত কয়েক মাস ধরে তারকা জুটির ডিভোর্সের জল্পনা চলছে । যদিও, তারকা জুটি প্রকাশ্যে এখনও কোনও কিছু জানাননি । সবটাই এখন গুঞ্জনের পর্যায়ের রয়েছে ।
টলিউডের দিকে যদি নজর দেওয়া যায়, তাহলে সেখানে গ্রে ডিভোর্সের তালিকা যিশু-নীলাঞ্জনার নাম উঠে আসছে । দীর্ঘ দুই দশকের দাম্পত্যজীবন । অনেকে বলছেন, তৃতীয় ব্যক্তিই তাঁদের বিয়ে ভাঙনের প্রধান কারণ । আপ্ত-সহায়কের সঙ্গে নাকি প্রেম করছেন যিশু । নীলাঞ্জনাও তাঁর নামের পাশ থেকে সরিয়ে ফেলেছেন সেনগুপ্ত । এখন তিনি শুধুই নীলাঞ্জনা, নিনি-চিনি'স মাম্মা ।