১৯৬৫ সালে পুজোসংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস 'আত্মপ্রকাশ'। পরের বছর, অর্থাৎ, ১৯৬৬ সালে ওই পুজোসংখ্যারই 'ঘুণপোকা' উপন্যাসের মাধ্যমে বৃহত্তর বাঙালি পাঠকের কাছে পৌঁছে গেলেন তখনকার নবীন লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলায় সাহিত্যের যে জোয়ার এসেছিল, পুজোসংখ্যাগুলি তাতেই বেঁধেছিল খুঁটি।
তখন পুজোসংখ্যা প্রকাশিত হতো অনেক কম। তবে, তা নিয়ে সাধারণ পাঠকের উন্মাদনার কোনও শেষ ছিল না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়ে এলো অথচ পুজোসংখ্যার পাতা থেকে একটুও মুখ তুলল না পাঠক কিংবা পাঠিকা, কফি হাউজের আড্ডায় তুফান উঠল কোন পুজোসংখ্যা কত ভালো হয়েছে তা নিয়ে- এমন সব দৃশ্যের সাক্ষী বাঙালি ছিল বহুযুগ ধরেই।
কেশবচন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠিত ভারত সংস্কার সভার সাপ্তাহিক ‘সুলভ সমাচার’ বিশেষ সংস্করণ প্রকাশ করে ‘ছুটির সুলভ’ নামে। এক পয়সার সেই বিশেষ সংখ্যা বেরোয় ১২৮০-এর আশ্বিন মাসে। তারপর থেকে ‘ভারতবর্ষ’, ‘বঙ্গবাণী’ প্রভৃতি পত্রিকা পুজো সংখ্যা প্রকাশ শুরু করে। প্রথম শারদ উপন্যাস ছাপা হয় শারদীয় বসুমতীতে।
রবীন্দ্রনাথ ‘পার্বণী’ নামের শারদীয় বার্ষিকীতেই প্রথম পূজার লেখা দেন। ‘পার্বণী’ ছিল প্রথম বাংলা বার্ষিকী। প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩২৫ সালে। ‘পার্বণী’ সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ছোট জামাই নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। ‘পার্বণী’র প্রথম পূজাবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথ ‘শরতে আজ কোন অতিথি এল প্রাণের দ্বারে’ গানটি ‘শরতের গান’ নাম দিয়ে লিখেছিলেন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদল এসেছে বাঙালির পাঠাভ্যাসে। এসেছে পুজোবার্ষিকীর সংখ্যাতেও। 'বাঙালি বই পড়ে না' এই তত্ত্বে সিলমোহর দিয়েই যেন প্রবলভাবে বিক্রি কমে গিয়েছে বইয়ের। এর প্রভাব থেকে মুক্ত নয় পুজোবার্ষিকীগুলিও। এখন তার দামও বেশি। আড়ে ও বহরেও সে নেহাত কম নয়। কিন্তু, তাতে কি পাঠকের আনুকূল্য পাওয়া গেল তেমন?
জানা গিয়েছে, গতবছরের বাজার একবারে মন্দা ছিল ৷ কিন্তু, এবার তেমনটা নয় । ২০২০ সালে করোনা এবং আমফান ঝড়ের জেরে প্রকাশনী সংস্থা এবং প্রিন্টিং প্রেসগুলির ব্যাপক ক্ষতি হয় । তাই গতবার বাজারে বই আসতে কিছুটা দেরি হয়েছিল । তবে এই বছর সময় মতোই দোকানে দোকানে পৌঁছে গিয়েছে বাঙালির সাহিত্যের শারদ সম্ভার।
কেমন বিক্রি হচ্ছে? এডিরজি'র সঙ্গে কথোপকথনে বইবিক্রেতা নিয়তি দাসের গলায়ও সেই 'মোবাইল'-এর প্রতিই অনুযোগ শোনা গেল। ষাট বছরেরও বেশি সময় ধরে পত্রপত্রিকার ব্যবসা তাঁদের। কিন্তু, হালে যে খুব বলার মতো জায়গায় নেই সেটা তাঁর কথাতেই স্পষ্ট। "বয়স্করাই বেশি কিনছেন পুজোবার্ষিকী। নতুন প্রজন্মের মধ্য়ে তেমন উৎসাহ চোখে পড়েনি। সবাই মোবাইলেই ব্যস্ত", আক্ষেপ নিয়তিদেবীর। যদিও, পুজোর মধ্যে এবং পুজো শেষ হওয়ার আগেই স্টলে রাখা সব পত্রিকা বিক্রি হয়ে যাবে বলে আশা তাঁর।
আশা পাঠকেরও। যে পাঠক, বহু অন্ধকার সময়ের মধ্যে থেকেই চিরকাল খুঁজে ফিরেছে পরশপাথর-সম পাঠের আলো। মোবাইল, সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন গেমিং-এর প্রবণতাকে ছাপিয়ে দুর্গাপুজোর উৎসব বাঙালির কাছে পড়ার উৎসবও হয়ে উঠবে আবার, সেই আগেরমতোই, সেই আশাতেই ভরে উঠুক তাঁর আজকের সপ্তমী-অষ্টমী-নবমী-দশমী।