দুর্গা পুজোর নিরিখে হিসেব করলে কেউ বলছেন দশমী, কেউ আবার বলছেন একাদশী। তবে, আজ নবমীও। ধর্মতলায় একদল জুনিয়র ডাক্তারদের অনশনের আজ নবমী। প্রায় ২০০ ঘণ্টা ধরে আমরণ অনশন চলছে। কলকাতা-উত্তরবঙ্গ মিলিয়ে অনশনরত ৩ ডাক্তার এখন হাসপাতালে। মূল অনশন মঞ্চের পাশে প্রতীকী অনশন মঞ্চ। বহু সাধারণ মানুষ, সিনিয়র ডাক্তাররা ১২ ঘণ্টার প্রতীকী অনশন করছেন জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে, তাঁদের গায়ে সাঁটা থাকছে 'প্রতীকী অনশনকারী' এই শব্দটুকু, এসব এখন ধর্মতলার চেনা ছবি, গত আট দিন ধরে। রবিবার সকাল থেকে প্রতীকী অনশনকারী লেখা কাগজ ঝুলছে এক বছর আটেকের মেয়ের জামায়।
রশ্মিতা ভট্টাচার্য, মায়ের সঙ্গে নিয়মিত আসে জুনিয়র ডাক্তারদের অনশনে। বিচারের দাবিতে ওঠা স্লোগানে গলাও মিলিয়েছে কদিন ধরেই। দাদা দিদিরা না খেয়ে লড়ছে। মাও ডাক্তার দাদা দিদিদের সঙ্গে প্রতীকী অনশন করবে জেনে রশ্মিতার বায়না, সেও না খেয়ে থাকবে ১২ ঘণ্টা। রশ্মিতার মা, মেয়ের আবদারে আপত্তি জানাননি। মা-মেয়ে দুজনেই সকাল ৯ টা থেকে রাত ন'টা পর্যন্ত অনশন করছে। রশ্মিতার মতো আরও নানা বয়সের নানা মানুষের গল্প অবাক করছে জুনিয়র ডাক্তারদের। রোজ কত নতুন নতুন গল্পের সাক্ষী থাকছে ধর্মতলা চত্ত্বর। অনিকেত-স্নিগ্ধাদের নামে নামে পুজো দিয়ে আসেন কত প্রবীণ প্রবীণা। ঠাকুরের ফুল মাথায় ছুঁইয়ে যান কত মানুষ। কেউ আবার কিছু বলে উঠতে পারেন না। শুধুই দাঁড়িয়ে থাকেন, অনশনরত তরুণ তরুণীর মুখের দিকে চেয়ে, আর চোখ মোছেন ঘন ঘন।
আরজি কর হাসপাতালে ডিউটিরত চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা পার করল প্রায় দু'দুটো মাস। বিচারের দাবিতে বাংলাজুড়ে জ্বলে ওঠা আগুনের আঁচ বাড়ছে। আট থেকে আশি, গ্রাম থেকে শহর, সব পেশার, সব এলাকার মানুষ প্রতিবাদের অংশ হয়ে উঠছে। ক্রমে গণ আন্দোলনের চেহারা নিচ্ছে আরজি করের ঘটনায় মানুষের প্রতিবাদ। বাংলার সবচেয়ে বড় উৎসবের মাঝেও বিচার চেয়ে মিছিল প্রতিবাদ স্লোগান উঠেছে বাংলায়।
গত এক মাসে, একটা স্লোগান মানুষের মুখে মুখে...''বিচার যত পিছোবে, মিছিল ততোই এগোবে'। হচ্ছেও তাই, সময়ের সাথে সাথে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে প্রতিবাদ, জমায়েত। কোনও মিছিল স্লোগানে মুখরিত, কোনও মিছিলে সুরে সুরেই প্রতিবাদ। কোনওটা আবার মৌন মিছিল। কোথাও তুলির টানে প্রতিবাদ এঁকে রাখছেন শিল্পীরা।
কোথাও টলমল পায়ে শিশুরাও হেঁটে বেড়াচ্ছে মিছিলে, হাঁতে ঘুরছে 'ওই ওয়ান্ট জাস্টিস' পোস্টার। হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে গেলে ক্লান্ত একটা শরীরকে বাবা মায়েরা কোলে তুলে নিচ্ছেন, ক্লান্তি ফুরোলে আবার হাঁটা শুরু। রাত দখলের ভিড়ে দাঁড়িয়ে অশীতিপর বৃদ্ধ, পরিবারের সবার বারণ সত্ত্বেও ঘর থেকে রাস্তায় নেমেছেন। কোথাও নাকে রাইলস টিউবের নল নিয়েই মিছিলে পা মিলিয়েছেন।
স্বাধীন দেশে এমন গণ আন্দোলনের সাক্ষী থাকেনি কলকাতা। মিছিল-প্রতিবাদ আগেও হয়েছে, কিন্তু সমাজের সব স্তরের মানুষকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়নি কোনও একটা ঘটনা। সমাজ বিশ্লেষকদের অনেকের মত, আরজি করের ঘটনা আসলে শুধুই ধর্ষণ কিমবা খুনের ঘটনা নয়, একই সঙ্গে নারী নিরাপত্তা, প্রসাশনিক ব্যর্থতা, সরকারি হাসপাতালে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির বিষয়গুলি সামনে নিয়ে এসেছে। তাছাড়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য মেয়েদের এবং প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের লড়াইয়ের পথ এখনও বন্ধুর। কত হেনস্থা, কত বলতে নে দেওয়া ঘটনায় তৈরি হওয়া ক্ষত থেকেই তিলোত্তমার আওয়াজ হয়ে উঠছেন মিছিলে আসা মানুষেরা। তাঁদের চিৎকারে বেরিয়ে আসছে কত বছরের জমিয়ে রাখা কান্না, যন্ত্রণা।
হাজার হাজার মানুষের পা মেলানো মিছিলে কত মুহূর্তের জন্ম হচ্ছে। পরিচিতি বদলে যাচ্ছে বন্ধুত্বে। এক মিছিল থেকে অন্য মিছিলে মানুষ শুধরে নিচ্ছেন নিজেদের ভুল। যত দূর গলা পৌঁছোয়, স্লোগান তুলতে গিয়ে গলা শুকিয়ে গেলে জল নিয়ে ছুটে আসছেন সম্পূর্ণ অচেনা মুখ। বেঁধে বেঁধে থাকা কাকে বলে, এই অসময়ে গোটা বাংলাকে দেখিয়ে দিয়ে গেল অভয়া। আর এই ঘোর অন্ধকার সময় পেল রশ্মিতার মতো, রশ্মিতার মায়ের মতো বিন্দু বিন্দু আলোকে। কলকাতা দেখল, প্রতিবাদ করার আসলে বয়স নেই, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে দরকার শুধু নির্ভীক একটা মন।