পাহাড় ভালবাসেন না, এমন মানুষ অল্পই আছেন! সেই ভালবাসা ও আকর্ষণের টান এমনই যে, বরফে ঢাকা পাহাড় বা বরফেঘেরা পাহাড়ি উপত্যকার তীব্র সৌন্দর্যের টানে নানা বাধা কাটিয়ে বারেবারে ফিরে যায় মানুষ। এমনিতেই দুর্গাপুজো শেষ হলেই, তার পরের সময়টায় বাঙালির মনপ্রাণ দার্জিলিংগামী হয়ে যায়! পুজোর পরের সময়টা যে এই শৈলশহরে ভ্রমণের জন্য আদর্শ। এই সময়ে পাহাড়ি আবহাওয়াও থাকে সুন্দর এবং স্বস্তিদায়ক। সাদা বরফে ঢাকা পড়েছে চরাচর। ঝিরিঝিরি তুষারপাতও চলেছে অবিরাম অব্যাহত। ঘুম থেকে উঠে এমন এক সকাল দেখার স্বপ্ন ভ্রমণপিপাসু পাহাড়প্রেমী মানুষের তো আজ থেকে নয়! শুরুতে হালকা তুষারপাত হলেও ক্রমশ হাওয়ার বেগের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিতে থাকবে বরফ। মাঝারি বরফ পড়তে থাকবে সারা রাত ধরে। তাপমাত্রা থাকবে শূন্যের কাছাকাছি বা বেশ খানিকটা নিচে। সকাল হতেই ঘুম ভাঙলে দেখতে পাওয়া যাবে, কী অপূর্বভাবে যেন ভোল বদলে তুষারস্নাত হয়ে উঠেছে প্রিয় পাহাড়- এমন একটি স্বপ্নও কি বারবার পাহাড়-রোম্যান্টিক মানুষরা দেখেন না? দেখেন। সেই কারণেই বারেবারে ফিরেও যান।
কিন্তু, সব ফেরাই তো সফল হয় না। কিছু কাঁটাও মিশে থাকে তাতে। বরফে ঢাকা পাহাড়ও আসলে সেরকমই। জীবনের সঙ্গেই যেখানে পদে-পদে মিশে থাকে মৃত্যুর বাধাও। মারা যান পর্যটকেরা। তেমনই একটি ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি। সান্দাকফু ঘুরতে গিয়ে মারা যান কলকাতার এক পর্যটক। মৃতের নাম আশিস ভট্টাচার্য। পুলিশ সূত্রে খবর, তিনি কলকাতার ভবানীপুরের বাসিন্দা। গত মঙ্গলবার রাতে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার কারণে তাঁর মৃত্যু হয়।
ইতিমধ্যেই চলতি মরসুমের প্রথম তুষারপাত হয়ে গিয়েছে দার্জিলিং-এ। বরফে সাদা হয়ে গিয়েছে সান্দাকফুও। শীতের সাজে সেজে উঠেছে পাহাড়ের প্রকৃতি। সাধারণত ডিসেম্বরের আগেই এমন বরফের সাজে সেজে ওঠা প্রকৃতি অন্তত এই রাজ্যের বাসিন্দাদের কাছে সুলভ নয়। সেই কারণেই এই নভেম্বরের সান্দাকফু পর্যটকদের কাছে অপ্রত্যাশিত আনন্দ বয়ে এনেছে।
কিন্তু, এই অপ্রত্যাশিত আনন্দ যাতে আরও নতুন করে কোনও বড় বিপদ ডেকে না আনে, তা নিশ্চিত করতে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। চলতি বছরে দুজন পর্যটক প্রাণ হারিয়েছেন। সেই কারণেই, প্রশাসনিক সূত্রে খবর, পাহাড়ে বেড়াতে আসা পর্যটকদের জন্য আরও কড়া নিয়ম চালু করার কথা ভাবছে তারা। শীঘ্রই পর্যটকদের শারীরিক পরীক্ষা চালু হতে পারে সেখানে। প্রশাসনের তরফে জিটিএ-র সঙ্গে আলোচনা করে পাহাড়ে বেড়াতে আসা পর্যটকদের জন্য স্বাস্থ্য সম্পর্কিত একটি নির্দেশিকা জারি করা হবে। যা চালু হবে খুব শীঘ্রই।
১১ হাজার ৯২৯ ফুট উঁচুতে সান্দাকফু পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ স্থান। জনপ্রিয় এই ট্রেকিং রুটে এখন ল্যান্ডরোভার গাড়ি চলতে শুরু করায় অনেক পর্যটকই উঠছেন। পর্বতারোহীরা মনে করছেন পাহাড়ে আচমকা বেশি উচ্চতায় শারীরিক সমস্যা হতেই পারে। অনেক সময়েই আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতেও অসুবিধা হয়। কিন্তু, সেই অসুবিধার তোয়াক্কা না করেই সাধারণ পর্যটকেরা স্পর্শ করে আসতে চাইছেন শিখর। যা ডেকে আনছে বিপত্তি।
তবু, বুকের ব্যথা, হাঁটুর ব্যথা, কোমরের ব্যথা নিয়েও পাহাড়ি গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে নেমে আসা রোদ, দিগন্তে তুষারাবৃত পর্বতের ঘোর লেগে যাওয়া সৌন্দর্যের আকর্ষণের কাছে ফিকে হয়ে যায় বহু নিষেধাজ্ঞা। মানুষ আর প্রকৃতির চিরাচরিত কথোপকথনের পাশ দিয়ে অন্ধকারে বয়ে যায় নিঃসঙ্গ পাহাড়ি নদী। এক হয়ে যায় জীবন ও মৃত্যু। মাথার উপর সূর্যের আলোর ভিতর দিয়ে জেগে থাকে চিরনতুন হিমালয়।