বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন বলিউড তথা ভারতের বিনোদন শিল্প। টেলিভিশন এবং বড়পর্দা- দুই মাধ্যমই সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়িক দিক দিয়ে। কনসালটেন্সি ফার্ম ‘EOI’ এবং ‘ইন্টারনেট অ্যান্ড মোবাইল অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া’ (IAMAI) তাদের ‘দ্য রব রিপোর্ট’-এ জানিয়েছে যে, ২০২৩ সালে ভারতীয় চলচ্চিত্র এবং বিনোদন শিল্পে ২২,৪০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই রিপোর্টেই উঠে এসেছে অতি বিপজ্জনক এক তথ্য। বিনোদনের গ্রাহক তথা দর্শকদের মোট সংখ্যার মধ্যে ৫১ শতাংশই অবৈধভাবে বিভিন্ন সিনেমা থেকে ওয়েব সিরিজ কনটেন্ট দেখে নেন। অবৈধভাবে বিনোদনের কনটেন্ট দেখে নেওয়া বা পাইরেসির অভিযোগ নতুন কিছু নয়। বহু বছর ধরেই এই নিয়ে সরব বলিউড বা টলিউড সহ দেশের নানা বিনোদন ইন্ডাস্ট্রি। অজস্র অভিযোগও উঠে এসেছিল বিষয়টি নিয়ে এর আগে। এই অবৈধ কার্যকলাপ রুখে দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণও করা হয়েছিল। নতুন এই রিপোর্টেই বোঝা যাচ্ছে, কোনও পদক্ষেপই আসলে তেমন কাজে লাগেনি। বরং বিনোদন ইন্ডাস্ট্রির বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে দুশ্চিন্তার মেঘ। যার নিটফল ২২,৪০০ কোটি টাকার বিপুল ক্ষতি! যা, কার্যত, সাম্প্রতিক সময়ের নিরিখে, নজিরবিহীনও বটে! এই ব্যবসা সংক্রান্ত আরও একটি তথ্য উঠে এসেছে, যা নিয়েও কপালে ভাঁজ পড়েছে বিশেষজ্ঞদের। জানা গিয়েছে, মোট পাইরেটেড পণ্যের মধ্যে ৬৩ শতাংশই দেওয়া হচ্ছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে।
উল্লেখ্য, আয়ের নিরিখে এই মুহূর্তে গোটা দেশের চতুর্থ বৃহত্তম শিল্পই হল এই বিনোদন। দেখা গিয়েছে, বিভিন্ন সিনেমা হলে গিয়ে মোবাইলে রেকর্ড করার ফলে ১৩,৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। OTT প্ল্যাটফর্ম থেকে পাইরেসির কারণে ৮,৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এর ফলে দেশটির সরকারও ৪,৩০০ কোটি টাকার জিএসটি সংগ্রহের ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। আসলে কপিরাইট আইন লঙ্ঘন করে একটি ছবি বা ওয়েব সিরিজ বা গান যদি সংগ্রহ করা হয়, তাহলে তাকেই পাইরেসি বলে। সম্প্রতি এই পাইরেসির প্রবণতা অনেক বেড়েছে।
ভারতে ডিজিটাল বিনোদনের বৃদ্ধি হচ্ছে ঝড়ের গতিতে। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ২০২৬ সাল নাগাদ চিত্রায়িত বিনোদন থেকে ব্যবসার অঙ্কটি ১৪,৬০০ কোটি টাকার অঙ্ক ছাড়িয়ে যাবে। বিনোদন শিল্পের বিশেষজ্ঞদেরও তেমনই প্রত্যাশা। কিন্তু, বর্তমান পরিস্থিতিতে এই সম্ভাবনা কার্যত মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা ওয়াকিবহালমহলের। তাঁদের মতে, সকলে সংঘবদ্ধ হয়ে এর বিরুদ্ধে লড়াই না করলে কিছুতেই ইতিবাচক ফলাফলা আশা করা যাবে না। একজোট হতে হবে উপভোক্তা থেকে শুরু করে স্টেকহোল্ডার, সাধারণ দর্শক থেকে শুরু করে বিনোদন শিল্পের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত সমস্ত মানুষকে।
ঠিক এই জায়গা থেকেই ফের একবার জেনে নেওয়া যাক, ভিডিয়ো পাইরেসি বিষয়টি কী? কনটেন্ট নির্মাতা বা কপিরাইট ধারকদের কাছ থেকে যথাযথ অনুমোদন ছাড়াই কপিরাইটযুক্ত ভিডিয়ো সামগ্রীর অবৈধ বিতরণ, অনুলিপি বা তার শেয়ার করাকেই বলে ভিডিয়ো পাইরেসি। একটা সময় বিনোদন বলতে এই দেশে ছিল কেবলই বড় পর্দা। ছোটপর্দার উত্থানের বেশ কযেকবছর পর যখন ভিডিয়ো ক্যাসেটের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে সরব হয়েছিলেন তৎকালীন বলিউডের কলাকুশলীরা। তাঁদের যুক্তি ছিল, বড় পর্দায় মুক্তি পাওয়া ছবির ব্যবসা প্রবল ধাক্কা খাচ্ছে ওই ছবির নকলের ভিডিয়ো বাজারে চলে আসায়। তা নিয়ে একের পর এক বিতর্ক এবং নানা কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও শেষমেশ দেখা গেল পরিস্থিতি যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রইল। ছবি প্রতিলিপি তৈরি করে ভিডিয়ো বানানো বা ইন্টারনেট আসার পর সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির অবাধে অবৈধ ডাউনলোড আর থামানো গেল না।
একেবারে সাম্প্রতিক এই রিপোর্ট ফের আরও একবার বুঝিয়ে দিয়ে গেল যে, সেই ট্র্যাডিশন শুধু চলছেই না। তা এতটা রমরম করে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করেছে যে, সাইবার অপরাধ দমন শাখার পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের কঠোর পদক্ষেপেও তা কমার লক্ষ্মণ নেই বিন্দুমাত্র। যে হারে বেড়েছে অবৈধ ডাউনলোড এবং ভিডিয়ো পাইরেসি সংক্রান্ত অপরাধের বহর, তাতে অবিলম্বে দৃষ্টান্তমূলক নতুন আইনি পদক্ষেপ ছাড়া তাকে আর কোনওভাবেই আটকানো সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। নির্মাতাদের কঠোর পরিশ্রম এবং শিল্পীর সৃজনশীলতাকে ক্ষুণ্ণ করা এই অপরাধের শেষ কোথায়? প্রশ্ন হাতড়াচ্ছেন অনেকেই। সাম্প্রতিক রিপোর্ট ফের বুঝিয়ে দিল, আসলে ঠিক উত্তরটা কারও কাছেই নেই।