'রবিনহুড'। বহরমপুর তথা মুর্শিদাবাদের মানুষের কাছে এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিতে এই বিশেষনটাই যথেষ্ট। তিনি অধীর রঞ্জন চৌধুরী। স্থানীয় বাসিন্দারা এক কথায় এখনও স্বীকার করেন, রবিনহুডের কাছে গেলে কেউ খালি হাতে ফেরে না।কিন্তু এবার? হাওয়া কি বদলাবে?
১৯৯১ সালে রাজীব গান্ধীর হাত ধরে কংগ্রেসে যোগদান করেন অধীর রঞ্জন চৌধুরী। ওই বছরই নবগ্রাম থেকে কংগ্রেস প্রার্থী হিসাবে বিধানসভা ভোটে অভিষেক। যদিও সেই বছর জিততে পারেনি তিনি। বাম আমলে দীর্ঘদিন ফেরার ছিলেন অধীর রঞ্জন চৌধুরী। ১৯৯৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও তিনি প্রার্থী হয়েছিলেন। জয়লাভ করেছিলেন তিনি। এরপর লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হাতেখড়ি। তারপর ১৯৯৯ থেকে টানা পাঁচ বারের বহরমপুর থেকে সাংসদ হন অধীর। যদিও অধীরের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগও রয়েছে বিরোধীদের। তাঁদের দাবি, একটা সময় অধীরের দাপটে রীতিমতো ভয়ে থাকত বিরোধীরা। দু'দফায় তিনি প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। তবুও তাঁকে নিয়ে নানা ক্ষোভ রয়েছে নিচু তলার কংগ্রেস কর্মীদের মধ্যে।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল-
গত লোকসভা নির্বাচনে বহরমপুর থেকে জয়লাভ করে সংসদে গিয়েছিলেন অধীর রঞ্জন চৌধুরী। তাঁর প্রাপ্ত ভোট ছিল ৫ লাখ ৯১ হাজার ১০৬টি। দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের অপূর্ব সরকার (ডেভিড)। ৫ লাখ ১০ হাজার ৪১০টি ভোট পেয়েছিলেন তিনি। এবং ১ লাখ ৪৩ হাজার ৩৮টি ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে ছিলেন BJP-র কৃষ্ণ জোয়ারদার।
বহরমপুর লোকসভার ভোট-চিত্র-
দীর্ঘদিন ধরে বহরমপুরের ক্ষমতা ছিল কংগ্রেসের হাতে। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে ধীরে ধীরে কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্কে থাবা বসাতে শুরু করে বিরোধীরা। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের দখলে ছিল ৫৬.৯ শতাংশ ভোট। এরপর ২০১৪ সাল এবং ২০১৯ সালে প্রাপ্ত ভোটের হার যথাক্রমে ৫০.৫ শতাংশ এবং ৪৬ শতাংশ।
লোকসভার পাশাপাশি বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে থাকা বিধানসভা আসনগুলিতে প্রাপ্ত ভোটের হার কমতে থাকে কংগ্রেসের। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রে কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোট ৪৮.৯ শতাংশ। এরপর ২০১৬ সাল এবং ২০২১ সালে বিভানসভায় প্রাপ্ত ভোটের হার যথাক্রমে ৪৫.৯ শতাংশ এবং ১৫.১ শতাংশ। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের হিসেবে বহরমপুরের লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে অবস্থিত ৭টি আসনের মধ্যে বড়ঞাঁ, কান্দি, ভরতপুর, রেজিনগর, বেলডাঙা এবং নওদা আসনের দখল নেয় তৃণমূল কংগ্রেস। বাকি একটি আসন অর্থাৎ নওদা আসনের দখল নেয় বিজেপি।
কংগ্রেসের ভোট ব্যাঙ্কে ধ্বস নামলেও প্রাপ্ত ভোটের হার বৃদ্ধি হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস এবং BJP-র। লোকসভা ভোটের নিরিখে ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ছিল যথাক্রমে ১৯.৭ শতাংশ এবং ৫০.১ শতাংশ। ওই দুটি লোকসভা নির্বাচনে BJP-র প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল যথাক্রমে ৫.৪ শতাংশ এবং ১১ শতাংশ।
চলতি লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থী
বিগত লোকসভা নির্বাচনগুলির মতো এবারও বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে কংগ্রেসের হয়ে লড়ছেন অধীর রঞ্জন চৌধুরী। তৃণমূলের হয়ে প্রার্থী হয়েছেন প্রাক্তন ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠান এবং BJP-র হয়ে দাঁড়িয়েছেন এলাকার চিকিৎসক নির্মল কুমার সাহা।
INDIA বিরোধী জোট-
লোকসভা নির্বাচনে NDA সরকারকে হঠাতে তৈরি হয়েছে বিরোধী জোট INDIA। তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি ওই নাম তিনিই দিয়েছেন। অথচ নির্বাচনী প্রচার মঞ্চ থেকে তিনি বারবার এটাও দাবি করেছেন যে, কেন্দ্রে জোট কার্যকর হলেও রাজ্যে একা লড়ছে তৃণমূল কংগ্রেস। এমনকি নাম না করে অধীর রঞ্জন চৌধুরীকে ইন্ডিয়া জোটের 'বড় গদ্দার' বলেও কটাক্ষ করেছেন তিনি।
অন্যদিকে অধীর রঞ্জন চৌধুরীও চ্যালেঞ্জ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রশ্ন তোলেন, বহরমপুর কেন্দ্র থেকে তৃণমূল কংগ্রেস হেরে গেলে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিজের পরাজয় মেনে নেবেন কি?
দীর্ঘদিন ধরে INDIA জোটের মধ্যে বৈঠক হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছিল জোট করে লড়াই করবে বিরোধীরা। কিন্তু এরাজ্যের ক্ষেত্রে তা হয়নি। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, কেন্দ্রে যখন কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করছেন অভিষেক, মমতা ঠিক তখনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একের পর এক আক্রমণ করে গিয়েছেন অধীর রঞ্জন চৌধুরি। একই দাবি তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় মুখপাত্র ঋজু দত্তের। তাঁর সাফ দাবি, শুধুমাত্র অধীর চৌধুরীর জন্যই বাংলায় INDIA জোট কার্যকর হয়নি। অধীরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যে তৃণমূল কংগ্রেস পথ চলবে না সেটাও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি।
চলতি নির্বাচনে ফ্যাক্টর
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মজার ছলে আগে বলতেন, অধীর মাখনের মধ্যে ছুরি চালানোর মতো মসৃনভাবে জিততে পারেন। তবে এবার হয়তো তাঁর নির্বাচনে জেতা ততটা মসৃন হবে না। বেশ বেগ পেতে হতে পারে। কেন তাঁরা একথা বলছেন?
মুর্শিদাবাদের মাটি কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি বলেই পরিচিত। অতীতে সেখানে বাম কংগ্রেসের মধ্যে বেশ কিছু সংঘর্ষের অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু সেসব এখন অতীত। রাজ্যে বাম কংগ্রেসের জোটের হাওয়া। সম্প্রতি মহম্মদ সেলিমের মনোনয়ন জমা দেওয়ার দিন তাঁকে সঙ্গ দিয়েছিলেন অধীর রঞ্জন চৌধুরী। এমনকি অধীরের গলায় সিপিএমের প্রতীক দেওয়া উত্তরীয় পরিয়ে দেন খোদ মহম্মদ সেলিম। অধীরকে জেতানোর জন্য আবেদনও করেন তিনি।
এবার অধীরের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলতে বাধ্য করেছে তৃণমূল কংগ্রেসের ইউসুফ পাঠান এবং দ্বিতীয়জন BJP-র প্রার্থী নির্মল কুমার সাহা। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মুসলিম যুবকদের একাংশ এখনও ক্রিকেটে মজে রয়েছেন। ফলে বহরমপুরের যুব সম্প্রদায়ের কাছে ইউসুফের জলপ্রিয়তা বেশ নজরকাড়া। দ্বিতীয়ত বহু বছর পর শক্তিশালী মুসলিম প্রার্থী পেয়েছেন বহরমপুরবাসী। যেখানে ৫০ শতাংশ মুসলিম ভোটার।
অন্যদিকে BJP-প্রার্থী করেছে নির্মল কুমার সাহাকে। যিনি বহরমপুরের বাইরে খুব একটা পরিচিত না হলেও এলাকার বাসিন্দাদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। এমনটাই দাবি স্থানীয়দের। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বহু মানুষকে বিনাপয়সায় সেবা করেছেন। তার প্রভাবও পড়তে পারে EVM-এ।
১৯৯৬ সালে প্রথম নবগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছিলেন অধীর। তারপর গঙ্গা দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। ২০২১ সালে পুরো মুর্শিদাবাদ জেলাতে একটি আসনও পায়নি কংগ্রেস। পরে উপনির্বাচনে কংগ্রেসের প্রার্থী বাইরন বিশ্বাস জিতলেও পরবর্তীতে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন তিনি। যে অপূর্ব বিশ্বাসকে তিনি অতীস সিংহের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে জিতিয়ে এনেছিলেন তিনি তৃণমূলে এবং যে হুমায়ুন কবীরকে রাজনীতিতে এনেছিলেন অধীর তিনিও তৃণমূলে।