ঘাটের কাছে গল্প বলে নদীর জল !
এই গল্প এক বা দু বছরের নয়। আনুমানিক ২৫০০ বছরের। কখনও সুলতানী, কখনও মুঘল আবার কখনও ব্রিটিশদের গল্প শুনতে পাওয়া যায় এই ঘাটে বসে নদীর জলে কান পাতলে। আসলে এই ঘাটের মধ্যে এক অদ্ভূত মাদকতা রয়েছে। যা আমার-আপনার জীবনের এক অনুরনন।
বারাণসী। বাঙালির সবসময়ের বেনারস। বিভূতিভূষণের গল্পে অপুর কৈশর। সত্যজিতের চিত্রনাট্যে আখতারি গজলে গমগম করা ঘোষাল বাড়ি থেকে গণেশ চুরির ঘটনা। আর সাম্প্রতিক সময়ে আইবুড়ো ছেলেকে নিয়ে গঙ্গায় তিনবারের ডুব দেওয়া গৌর চক্রবর্তীর জীবন। কলকাতার পর এই শহর বাঙালির নিজের শহর। যেখানে আজও রথ দেখা ও কলা বেচা দুটোই পাওয়া। যেখানে তীর্থের সঙ্গেই হাওয়া বদল করতে বেশি পছন্দ করে মধ্যবিত্ত।
এখানে বলা ভাল আজকের বারাণসী, একদা বাঙালির কাছে ছিল কাশী নামেই পরিচিত। বারো ঘাটের এই শহরে বাঙালি একসময় থেকেছে, ব্যবসা করেছে, নিজেদের প্রভাব-পতিপত্তি বিস্তার করেছে। একসময় কাশিকে বলা হয় বাঙালির দ্বিতীয় হোমল্যান্ড। জ্ঞানব্যাপীর গলি হয়ে কালের নিয়ম ধরে সময় হেঁটে গিয়েছে। একটু একটু করে বদলেছে এই শহর। তবুও, বেনারসী জর্দা দেওয়া এক খিলি পান মুখে এখনও ঘাটের ধারে বসে জলের থেকে গল্প শোনার অভ্যাস ছাড়েনি বাঙালি। কারণ, সন্ধ্যা নামলেই যে দসাশ্বমেধ হাত নেড়ে ডাকে, ওই যে শুরু হয়ে গেল গঙ্গারতি। ডমরু, শঙ্খের ঘনঘটায় তৈরি হয় এক আচর্য শব্দব্রহ্ম। যা উপভোগ করতেই ঘাটের কাছে বারবার ছুটে আসা।
ভারতের লোকসভা ভোটের ইতিহাসের সঙ্গে বারাণসী ছিল গোড়া থেকে। রাজধানী দিল্লি থেকে উত্তরপূর্বে উত্তরপ্রদেশের এই কেন্দ্র। লখনউ থেকে যার দূরত্ব ৩২০ কিলোমিটার। রাজ্যের ৮০টি লোকসভার মধ্যে এই কেন্দ্র ৭৭ নম্বরে। দেশের প্রথম নির্বাচনে নাম ছিল বারাণসীর। ১৯৫২ সালে এই কেন্দ্র থেকে প্রথম সাংসদ কংগ্রেসের রঘুনাথ সিং। ১৯৬৭ সালে বারাণসী জয় করেছিল বামেরা। সাংসদ হয়েছিলেন সত্য নারায়ণ সিং।
রাজনৈতিক মহল বলে, ২০১৪ সালের আগে পর্যন্ত দেশের আর পাঁচটা আম লোকসভা কেন্দ্রের মতোই দেখা হতো এই উত্তরপ্রদেশের বারাণসীকে। তবে, এই লোকসভা কেন্দ্রের একটি মাহাত্ম্য আছে। সীমানা পুর্ননবীকরণের পরেও বারাণসীর অন্তর্গত রয়েছে পাঁচটি বিধানসভা। এরমধ্যে রোহানিয়া আরও ব্যতিক্রমী। কারণ, উত্তরপ্রদেশের মধ্যেই এই কেন্দ্রে রাজ করেন প্যাটেল-ভূমিদার সমাজ। তাই ২০১২ থেকে ২০২২, এই বিধানসভা এখনও আপনা দলের দখলে। বাকি চারটি কেন্দ্রে এগিয়ে বিজেপি। কারণ, এই চার কেন্দ্রে হিন্দু ভোটারের সংখ্যা প্রায় ৬০ শতাংশ।
১৯৫২ থেকে ২০০৯, এই সময়কালে বারাণসীতে সাতবার করে জিতেছে কংগ্রেস ও বিজেপি। ২০০৯ সালে এই কেন্দ্রে প্রথম বড় মুখ বিজেপি নেতা ও প্রাক্তন কেন্দ্রীয়মন্ত্রী মুরলী মনোহর যোশী। আর ২০১৪...। বারাণসীর ভাগ্যে টার্নিং পয়েন্ট।
২০১৪। দিল্লিতে হেড অন লড়াই কংগ্রেস বনাম বিজেপির। সনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারকে চ্যালেঞ্জ দিতে বাজপেয়ী-আডবাণী পরবর্তী সময়ে নিজেদের তূণ থেকে সেরা তিরকে বার করলেন তৎকালীন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ। মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়, এই স্লোগানে সেই প্রথমবার লোকসভার নির্বাচনী ময়দানে প্যাড-আপ করলেন পদ্মের পোস্টারবয় নরেন্দ্রদাস দামোদরদাস মোদী।
পাল্টা ঝাপিয়ে পড়ল কংগ্রেস। হাতিয়ার হল গুজরাত দাঙ্গা। কারণ, প্রাথমিক ভাবে ঠিক ছিল নিজের রাজ্য ভাদোদরা থেকেই লড়াই করবেন নরেন্দ্র মোদী। এখানেও কংগ্রেসের গ্রাস থেকে ভোটের খেলা ঘুরিয়ে দিলেন সেই অমিত শাহ। বিজেপি ঘোষণা করল, বারাণসী থেকে নরেন্দ্র মোদীর নাম। স্পষ্ট বার্তা পেল রাজনৈতিক মহল। যে বার্তায় বুঝিয়ে দেওয়া হয় ভবিষ্যতে রামমন্দির তৈরিতে আরও গতি পেতেই উত্তরপ্রদেশ অপেক্ষা করছে ভাবী প্রধানমন্ত্রীর।
শুরু হল বিরোধী শিবিরে জল্পনা। কে হবেন নরেন্দ্র মোদীর প্রতিপক্ষ ? রাহুল গান্ধী, কেসি বেণুগোপাল, মণিশঙ্কর আইয়ার নাকি রায়বরেলিয়ার ছেড়ে বারাণসীতে আসবেন খোদ সনিয়া গান্ধী ? এই প্রশ্ন শুধুমাত্র জল্পনাতেই রয়ে গিয়েছিল। নরেন্দ্র মোদীকে শেষ পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ দিতে দসাশ্বমেধের ময়দানে উত্তীর্ণ হলেন আপ প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল। এরপর বাকিটা...।
প্রতিপক্ষ কেজরিওয়ালকে ৩ লক্ষ ৭১ হাজারের বেশি ভোটে হারিয়ে বারাণসী থেকে প্রথমবার দিল্লিতে বিজেপি প্রার্থী নরেন্দ্র মোদী। পরিসংখ্যান বলছে, মোট ভোটের ৫৬.৩৭ শতাংশ পড়েছিল মোদীর ঝুলিতে। ২০০৯ সালের তুলনায় এই কেন্দ্রে বিজেপির ভোট বেড়েছিল গড়ে ২০ শতাংশ। চমকপ্রদ ছিল আপের লড়াই। প্রথমবার ওই কেন্দ্রে লড়াই করে কেজরিওয়াল প্রাপ্ত ভোট ছিল ২০.৩০ শতাংশ।
২০১৯ সালেও বারাণসী মোদী-ময়। প্রতিপক্ষ সমাজবাদী পার্টির শালিনী শর্মা। এবার জয়ের মার্জিন হল ৪ লক্ষ ৭৯ হাজারের একটু বেশি। মোট ভোটের ৬৩ শতাংশ প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে। রাজনৈতিক মহলের দাবি, উন্নয়ন তাসে মোদী জিতলেন মহিলা, মুসলিম এবং নতুনের ভোটে। বিজেপির ভোট বাড়ল গড়ে ৭.২৫ শতাংশ।
কী পেল বারাণসী গত ১০ বছরে ?
বনেদিয়ানার ভিতকে অটুট থেকে আমূল আধুনিকীকরণ। বলা যেতেই পারে বেনারস কী ছিল, আর কী হল ? আজ উত্তরপ্রদেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র বারাণসী। রেল, বিমানের সঙ্গে আগামীদিনে জুড়বে মেট্রো। তৈরি হবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম। এরপরেও গর্জন উঠেছে বিরোধী শিবির থেকে। কংগ্রেস প্রার্থী অজয় রাইয়ের সমর্থনে জনসভা থেকে রাহুল গান্ধী ও অখিলেশ যাদবের হুঙ্কার, গুডবাই মোদীজি !
বারাণসী কী বলবে ? অপেক্ষায় দেশের সপ্তম দফা। ১ জুন দেশের নজর এই কেন্দ্রের দিকে। অপেক্ষা এক নজিরের। জিতলে এই কেন্দ্র থেকে হ্যাটট্রিক করবেন নরেন্দ্র মোদী। এবং তিনি হবেন ভারতের প্রথম, যিনি পরপর তিনবার একই কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়ে দিল্লির মসনদে বসবেন।