'Democracy is the government of the people, by the people and for the people'
গণতন্ত্র । কোনও একটি দেশের বা রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকদের অধিকারের নাম । প্রতি পাঁচ বছর অন্তর তার উদযাপনও হয় । নাম দেওয়া হয় গণতন্ত্রের উৎসব । ভোটের সময়ই এমন শব্দবন্ধ ব্যবহার করে থাকি আমরা । সাধারণত, লোকসভা ভোটের মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যত নেতাকে বেছে নেয় নাগরিকরা । ভোটদানের মাধ্যমে মতামত প্রদান করেন তাঁরা । ভারত ইতিমধ্যেই ১৮টি লোকসভা ভোটের সাক্ষ্মী থাকল ।
শুরুটা হয়েছিল ১৯৫২ থেকে । প্রতি পাঁচ বছর অন্তর ভোট...লম্বা পথ পেরিয়ে আজ, ২০২৪ সাল । ভারতে আরও একটা ভোট । আগামী ৫ বছরের জন্য দেশের নেতা বেছে নেওয়ার সময় । চলতি মরসুমে সাত দফায় ভোট-পর্ব । লড়াই একাধিক রাজনৈতিক দলের, লড়াই একাধিক মুখের । যাঁদের পরীক্ষার রেজাল্ট ৪ জুন । এই দিনটাই ঠিক করে দেবে, দিল্লির মসনদ কোন রঙে রঙিন হতে চলেছে । তবে তার আগে ভারতের গত ১৭টি লোকসভা নির্বাচনের বছর, ভোট পর্বের সময় থেকে কোন সালে কোন দল সরকার গঠন করেছে, একনজরে দেখে নেওয়া যাক, অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের সাত-সতেরো ।
১৯৫২ সালে পথ চলা শুরু নির্বাচনী গণতন্ত্রের । লোকসভা ভোটের 'জন্মদিন'-ও বলা যেতে পারে । ওই বছরেই প্রথমবার ভোটদানের মাধ্যমে সরকার গঠন করা হয় । প্রথম বছর নির্বাচন প্রক্রিয়া চলেছিল প্রায় ৪ মাস । নির্বাচন প্রক্রিয়ার তারিখ ২৫ অক্টোবর ১৯৫১ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ । ৩৬৪টি আসন পেয়ে দেশে সরকার গঠন করে কংগ্রেস । প্রধানমন্ত্রী হন জহওরলাল নেহেরু । শুরু হয় কংগ্রেসি রাজ ।
১৯৫৭ সাল । দ্বিতীয় লোকসভা ভোট । নির্বাচন প্রক্রিয়া চলেছিল ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪ মার্চ পর্যন্ত । প্রথমবারের তুলনায় ভোট প্রক্রিয়া চলেছিল কমদিন । ৩৭১ আসন জিতে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফের দিল্লির তখতে কংগ্রস । আবারও প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু । ওই বছর কংগ্রেসের ভোট শতাংশ ছিল ৪৭.৭৮ ।
১৯৬২-র লোকসভা ভোট ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত হয় । যত বছর এগিয়েছে, ভোট পর্ব তুলনামূলক কমদিনের মধ্যেই সেড়ে ফেলার ট্রেন্ড দেখা গিয়েছে । তৃতীয় লোকসভা ভোটেও একই ছবি । ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলেছিল ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া । ফলাফল প্রকাশের পর দেখা যায়, হ্যাটট্রিক করে কংগ্রস সেইসঙ্গে নেহরুও । তবে গত দুইবারের তুলনায় আসন সংখ্যা কমে সামান্য । ৩৬১টি আসন পেয়েছিল কংগ্রেস । কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ১৯৬৪ সালে প্রয়াত হন জহওরলাল নেহেরু । সেইসময় তাঁর শূন্য আসন পূর্ণ করতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে । কিন্তু, তৃতীয় লোকসভা ভোটের মেয়াদকাল পূর্ণ হওয়ার আগেই মৃত্যু হয় লাল বাহাদুর শাস্ত্রীরও ।
চতুর্থ লোকসভা ভোট সংঘটিত হয় ১৯৬৭ সালে । ১৭ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলেছিল ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া । আবারও ভোটে জিতে সরকার গঠন করে কংগ্রেস । তবে আসন সংখ্যা কমে যায় ২৮৩-তে । জহওরলাল নেহেরু, লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর পর দেশচালকের আসনে বসেন ইন্দিরা গান্ধী । দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী । যদিও, সেইসময় আরেক প্রধানমন্ত্রীর পদ প্রয়াসী মোরারজি দেশাইয়ের সঙ্গে বিরোধ তুঙ্গে ওঠে ।
৪র্থ লোকসভার কার্যকাল চলাকালীন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে মোরারজী দেসাই, কামরাজ ইত্যাদি নেতার অন্তর্কলহ দেখা দিয়েছিল । ফলে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় কংগ্রেস । বিভাজনের পর পঞ্চম লোকসভা ভোটে মূল লড়াই ছিল ইন্দিরা বনাম মোরারজি দেশাই । কিন্তু, ১৯৭১ সালের লোকসভা ভোটে আসন সংখ্যা আরও বাড়িয়ে ক্ষমতা দখল করেন ইন্দিরা গান্ধীই । ১ মার্চ থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত সংঘটিত লোকসভা ভোটের ফলাফলের পর ৩৫২ টি আসন জেতে ইন্দিরার কংগ্রেস । আবারও তখন প্রধানমন্ত্রীর পদে নির্বাচিত হন তিনি ।
১৯৭৭, ষষ্ঠ দফা লোকসভা নির্বাচন । বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের কারণে প্রথম দেশের শাসনভার কংগ্রেসের হাতছাড়া হয় । তার একটি অন্যতম কারণ ছিল ইন্দিরা গান্ধী নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার অন্তর্বর্তী জরুরীকালীন অবস্থার ঘোষণা । কংগ্রেসের বিরোধিতায় তৈরি হয় জনতা পার্টি । ১৬ থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত ভোট প্রক্রিয়ায় শেষপর্যন্ত ইন্দিরাকে হারিয়ে ২৯৫ আসন নিয়ে ক্ষমতা দখল করে জনতা পার্টি । প্রধানমন্ত্রী হন মোরারজি দেসাই ।
তিন বছর পরই অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম লোকসভা ভোট । দলের সদস্যদের মধ্যে দেশাইয়ের মতবিরোধ, দুর্বল অবস্থান নানা কারণে ভেঙে পড়ে জনতা পার্টির সরকার । আস্থা ভোটে হারের পর পদত্যাগ করেন মোরারজি । এরপর ১৯৮০ সালের ৩ ও ৬ জানুয়ারি সংঘটিত হয় সপ্তম দফা । পুনরায় ক্ষমতায় আসেন ইন্দিরা গান্ধী । ৩৫৩ আসন জিতে দিল্লির মসনদে বসেন ।
১৯৮৪, অষ্টম লোকসভার ভোট । তার আগে ঘটে গিয়েছে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ড, সেইসঙ্গে শিখ বিরোধী দাঙ্গা...বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের পরপরই ডিসম্বেরে অনুষ্ঠিত হয় ভোট । ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া চলেছিল ২৪, ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর । ৪১৪ আসন জিতে ঐতিহাসিক জয় লাভ করে কংগ্রেস । তখন প্রধানমন্ত্রী হন ইন্দিরা পুত্র রাজীব গান্ধী ।
নবম লোকসভা ভোট হয়েছিল ১৯৮৯ সালের ২২ ও ২৬ নভেম্বর । সেইসময় রাজীব গান্ধী নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় । তখন সরকার গঠন করে জনতা দল । নবম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেনে ভিপি সিং ।
রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ড, মন্দির মসজিদ ইস্যু ইত্যাদি ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠিত হয় দশম লোকসভা অর্থাৎ ১৯৯১ সালের ভোট । কোনও দলই সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করেননি । সেইসময় ২৪৪ আসন নিয়ে সরকার গঠন করে কংগ্রেস । প্রধানমন্ত্রী হন পিভি নরসিমা রাও ।
১৯৯৬ পালাবদলের সাল । ২৭ এপ্রিল, ২ মে, ৭ মে ভোট পর্ব অনুষ্ঠিত হয় । সরকার গঠন করে ভারতীয় জনতা মোর্চা পার্টি । প্রধানমন্ত্রী হন অটল বিহারী বাজপেয়ী । এরপর ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ দুইবছর পরপর লোকসভা ভোট অনুষ্ঠিত হয় । প্রথমবার বাজপেয়ীর সরকার গঠিত হলেও তা ১৩ দিনের মধ্যে ভেঙে পড়ে। ১৯৯৯ সালে ফের ভোট হলে আবারও প্রধানমন্ত্রীর পদে বসেন অটল বিহারী বাজপেয়ী ।
২০০৪ লোকসভা ভোটের পর প্রত্যাবর্তন হয় কংগ্রেসের । ভোট হয়েছিল ২০, ২৬ এপ্রিল ও ৫ মে,১০ মে । ইউপিএ জোটের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে দিল্লির তখতে ফের নাম লেখায় কংগ্রেস । প্রধানমন্ত্রী হন মনমোহন সিং ।
২০০৯-এও ফের ক্ষমতায় আসে ইউপিএ জোট । পাঁচ দফায় ভোট অনুষ্ঠিত হয় । দেশের ১৫ তম প্রধানমন্ত্রী হন মনমোহন সিং ।
২০১৪ তে ফের পালাবদল । একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসে । ৭ এপ্রিল থেকে ১২ মে পর্যন্ত ভোট পর্বে বিজেপির ঝুলিতে আসে ২৮২ আসন । প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন নরেন্দ্র মোদী ।
২০১৯-এ আসন সংখ্যা আরও বাড়িয়ে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হন নরেন্দ্র মোদী । ১১ এপ্রিল থেকে ১৯ মে পর্যন্ত চলেছে ভোটপ্রক্রিয়া । ফলাফল প্রকাশ্যে আসার পর দেখা যায় ৩০৩ আসন নিয়ে ক্ষমতায় বিজেপি সরকার
২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে ফলের অপেক্ষায় দেশবাসী । 'এবার ৪০০ পার' করে বিজেপি সরকারই ফের ক্ষমতায় আসবে, নাকি পালাবদলের সাক্ষ্মী থাকবে অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন, তা জানা যাবে আগামী ৪ জুন ।