সাদা-নীল সুতির শাড়ি, পায়ে হাওয়াই চটি...এই বেশেই তাঁকে চেনে বাংলার মানুষ তথা গোটা বিশ্ব । অগ্নিকন্যা বলা হয় তাঁকে । রাজনীতির জগত দিদি বলে সম্বোধন করে তাঁকে । যার হাত ধরে তৃণমূলের সূচনা, উথ্থান । তৃণমূলের স্তম্ভ তিনি । সর্বোপরি পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । লড়াইয়ের আরও একটা নাম । এমনটাই মনে করে তৃণমূল । শুরু ছাত্রজীবন থেকে । সক্রিয় রাজনীতিতে আসা কম বয়সেই । নানা ঘাত-প্রতিঘাত, আন্দোলন-বিক্ষোভের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে তৈরি হয় বিরোধী দলনেত্রীর ইমেজ । তারপর বাংলার মুখ্যমন্ত্রী । বাংলার 'নিজের মেয়ে' । আর এখন তিনি জাতীয় রাজনীতিতে মোদী বিরোধিতার প্রধান মুখ ।
সাংসদ হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক কেরিয়ার শুরু । সেইসময় তৃণমূল কংগ্রেসের কোনও অস্তিত্ব ছিল না । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামের পাশে লেখা হত কংগ্রেস নেত্রী । কংগ্রেসের টিকিটেই ১৯৮৪ লোকসভা ভোটে যাদবপুর কেন্দ্র থেকে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে প্রথমবার সাংসদ হন তিনি । দেশের অন্যতম সর্বকনিষ্ঠ সাংসদ । তবে, ১৯৮৯-এ কংগ্রেস বিরোধী হাওয়ায় যাদবপুর থেকে হারলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । তারপর ১৯৯১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত কলকাতা দক্ষিণ আসনে পরপর ৬ বারের সাংসদ হন । তবে, ওই সময়কালের মধ্যেই কংগ্রেসের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন হয় মমতার । প্রতিষ্ঠিত হয় অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেস । খুব কম সময়ের মধ্যে দীর্ঘকাল বামফ্রন্ট-শাসিত পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিরোধীশক্তিতে পরিণত হয় । ধীরে ধীরে তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারে যুক্ত হয় সিঙ্গুর আন্দোলন,২৬ দিনের অনশন,নন্দীগ্রাম গণহত্যা ...একের পর এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা । দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ২০১১-তে ঘটল পালাবদল । বাংলা পেল প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী ।
মমতার দীর্ঘ সংসদীয় কেরিয়ার । ২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর নিয়ম মেনেই সাংসদ পদ ছাড়তে হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে । ২০০৯ সালের ভোটে জিতে শেষবার সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন । তারপর কেটে গেল আরও তিনটি লোকসভা ভোট । শনিবার, ১ জুনই শেষ হয়েছে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোট । প্রায় দেড়মাসব্যাপী ভোট । তারও আগের থেকে পথে নেমেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । কখনও তীব্র রোদ, কখনও ঝড়-জল...সব উপেক্ষা করে ছুটে বেরিয়েছেন বাংলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে । পরনে সেই সুতির সাদা শাড়ি, সময়ে সময়ে হয়তো বদলেছে পাড়ের রং । কখনও সাদার সঙ্গে নীল, কখনও সবুজ, কখনও স্কাই গ্রিন, কখনও কমলা রঙের পাড় । পায়ে সেই হাওয়াই চটি । তিনি প্রার্থী নন । কিন্ত, দলের নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে পরীক্ষা যে তাঁরও ।
লোকসভা নির্বাচনের ঘোষণা হল ১৬ মার্চ । তখন অসুস্থ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । মাথা ফেটে গিয়েছিল তাঁর । প্রচার আদৌ করতে পারবেন কি না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শুরু হয় জল্পনা । সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে দীর্ঘ ১০-১২ দিনের বিশ্রামের পর চেনা মেজাজেই কামব্যাক হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । ৩১ মে থেকে শুরু হল টানা প্রচার । শুরু হল উত্তরবঙ্গ দিয়ে ।
কোচবিহার থেকে শুরু করেছিলেন নির্বাচনী জনসভা । তারপর একে একে আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি থেকে মালদহ...ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলেন পশ্চিমের জেলাগুলিতে । সেইসময় বাংলায় চলছে তীব্র দাবদাহ । সেইসময় প্রয়োজন ছা়ড়া বাইরে বেরতে বারবার নিষেধ করছিলেন চিকিৎসকরা । কিন্তু, ভোট যে বড় বালাই । দলের কর্মীদের ভোকাল টনিক দিতে, তাঁর বক্তৃতায় আবারও বাংলার মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে মমতা গরমের মধ্যেই ছুটে চললেন এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত । হাওয়াই চটি ছিড়ল, সেপটিফিন দিয়ে সেলাই করলেন, কিন্তু থামলেন না মমতা ।
এত গরমে কেন দীর্ঘ দিন ধরে নির্বাচন, প্রশ্ন তুলে বারবার বিজেপিকে, নির্বাচন কমিশনকে তুলোধনা করতেও দেখা গিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে । শুধু বাংলা নয়, রাজ্যের বাইরেও প্রচারে গিয়েছিলেন তিনি ।
টানা প্রায় দেড় মাস বাড়ি থেকে ছিলেন দূরে। জেলা সফরের সময় ফিরতে পারেননি বাড়ি । কলকাতার কাছাকাছি থাকলেও কালীঘাটের বাড়িতে ফেরেননি । প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রতিকূলতা, অসুস্থতা সব উপেক্ষা করে দুই মাস ধরে জনসংযোগ সেরেছেন । পরিসংখ্যান বলছে, দু'মাসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাই ১০৭ টি জনসভা ও রোড শো করেছেন। হেঁটেছেন কয়েক কিলোমিটার পথ । তার মাঝে মাঝে কখনও চায়ের দোকানে, কখনও মোমোর দোকানে সেরেছেন জনসংযোগ । গত দুই মাস 'বিশ্রাম' শব্দটা তাঁর ডিকশনারিতেই ছিল না ।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সর্বশেষ প্রচার ছিল কলকাতায় । প্রচারের শেষ দিনেও রাজপথ সাক্ষ্মী থেকেছে তাঁর দীর্ঘ পদযাত্রার । ভরপুর উদ্যমের সঙ্গে একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রচার চালিয়েছেন । অনেকেরই প্রশ্ন, এত এনার্জি কোথা থেকে পান মুখ্যমন্ত্রী ? আর তাঁর হয়তো উত্তর 'অফুরান প্রাণশক্তি'। যার উৎস বাংলার জনতা । এমনটাই বলেন তৃণমূলের কর্মীরা ।