ভোট ভোট ভোট । দেড় মাস ধরে চলা গণতন্ত্রের উৎসবের সমাপ্তি হয়েছে ১ জুন । বলা ভাল, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের পালা শেষ । এবার মানুষের রায় জানবার পালা । দিনের পর দিন রোদে ঘেমে, বৃষ্টিতে ভিজে, শরীর খারাপ উপেক্ষা করে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ভোট ভিক্ষায় ছুটে বেরিয়েছেন প্রার্থীরা । এবার তাঁদের ভাগ্যপরীক্ষার সময় এসেছে । মঙ্গলবার, ৪ জুন সেই দিন । অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের ফলপ্রকাশ ।
বুথ ফেরত সমীক্ষায় ইঙ্গিত, দেশজুড়ে ফের গেরুয়া ঝড় উঠবে । মঙ্গলবার গোটা দেশের পাশাপাশি নজর থাকবে বাংলা দিকে । পশ্চিমবঙ্গে মোট ৪২টি আসনের লড়াই । একাধিক বুথ ফেরত সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে পশ্চিমবঙ্গেও ২০ টিরও বেশি আসন নিজেদের ঝুলিতে ভরবে পদ্ম শিবির । গত লোকসভা নির্বাচনের থেকেও বাংলায় ভাল ফল করবে বিজেপি, এমনই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে এক্সিট পোলে । তবে, বুথফেরত সমীক্ষা যে সবসময় মিলে যায় এমনটাও নিশ্চিত করে বলা যায় না । ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় গেরুয়া ঝড় উঠবে নাকি সবুজ সুনামি হবে, 'শূন্য'-র বদনাম কি ঘোচাতে পারবে সিপিএম,সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে ৪ জুন । তবে, তার আগে রাজ্যের ৪২ আসনে গতবার অর্থাৎ ২০১৯ লোকসভা ভোটের ফলাফল কেমন ছিল, কোন কেন্দ্রে কোন রঙের ঝড় উঠেছিল, তা একনজরে দেখে নেওয়া যাক ।
চলতি বছরের নির্বাচন সাত দফায় হয়েছে । প্রথম দফায় তিন কেন্দ্র অর্থাৎ কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়িতে ভোট ছিল । এই তিন কেন্দ্রে কেমন ছিল গতবারের ফলাফল
উত্তরের তিন কেন্দ্রই বিজেপির দখলে । কোচবিহারে তৃণমূলের পরেশচন্দ্র অধিকারীকে হারিয়ে ৭ লাখ ৩১ হাজার ৫৯৪ ভোট পেয়ে জেতেন বিজেপির নিশীথ প্রামাণিক । চলতি বছরও বিজেপির টিকিটে এই কেন্দ্রের প্রার্থী হয়েছেন নিশীথ । আলিপুরদুয়ার থেকে গত বার সাংসদ হয়েছিলেন বিজেপির জন বার্লা । তৃণমূলের দশরথ টির্কে-কে হারিয়ে জিতেছিলেন । পেয়েছিলেন ৭,৫০,৮০৭ ভোট । যদিও, এবার তাঁকে টিকিট দেয়নি বিজেপি । ২০২৪-এ আলিপুরদুয়ারে বিজেপির প্রার্থী মনোজ টিগ্গা । অন্যদিকে, জলপাইগুড়িতে ৭,৬০,১৪৫ ভোট পান বিজেপি প্রার্থী জয়ন্ত কুমার রায় । এবারও ওই কেন্দ্র থেকে তাঁর উপর আস্থা রেখেছে বিজেপি ।
এবার নজর দেওয়া যাক দার্জিলিং, রায়গঞ্জ ও বালুরঘাটের দিকে । দ্বিতীয় দফায় ভোট হয়েছে এই তিন কেন্দ্রে । দার্জিলিঙে বিজেপির টিকিটে গত বার তৃণমূলের অমর সিং রাইকে হারিয়ে জিতেছিলেন রাজু বিস্তা । পেয়েছিলেন ৭ লাখ ৫০ হাজার ৬৭ ভোট । এবারও বিজেপির তুরুপের তাস রাজুই ।
রায়গঞ্জ ও বালুরঘাটে গত বার জয়জয়কার হয়েছিল বিজেপির । রায়গঞ্জ থেকে ৫,১১,৬৫২ ভোট পেয়ে জেতেন দেবশ্রী চৌধুরী । অন্যদিকে, বালুরঘাট থেকে বিজেপি সাংসদ হন সুকান্ত মজুমদার । গত বার তৃণমূলের অর্পিতা ঘোষকে হারিয়ে ৫,৩৯,৩১৭ ভোট পেয়ে ওই কেন্দ্রে দখল নেয় বিজেপি ।
তৃতীয় দফায় ভোট ছিল চার কেন্দ্র । মালদহ উত্তরে বিজেপির টিকিটে জেতেন খগেন মুর্মু । তাঁর ঝুলিতে ছিল ৫,০৯,৫২৪ ভোট । এবারও ওই কেন্দ্র থেকে বিজেপি প্রার্থী ছিলেন তিনি । ২০১৯-এর ফলাফল অনুযায়ী মালদহ দক্ষিণ কংগ্রেসের অধীনে । বিজেপির শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরীকে হারিয়ে ৪,৪৪,২৭০ ভোটে জেতেন আবু হাসেম খান চৌধুরী । জঙ্গিপুর ও মুর্শিদাবাদ তৃণমূলের দখলে । গতবার কংগ্রেসের থেকেও জঙ্গিপুর ছিনিয়ে নেয় তৃণমূলের খলিলুর রহমান । ভোট প্রাপ্তি ছিল ৫,৬২,৮৩৮ । এবারও তিনি ওই কেন্দ্রের তৃণমূলের প্রার্থী । মুর্শিদাবাদে তৃণমূলের টিকিটে ৬ লাখ ৪ হাজার ৩৪৬ ভোটে পান আবু তাহের খান । ২০২৪-এর ভোটেও তাঁর উপর আস্থা রেখেছে দল
চলতি বছর চতুর্থ দফায় ৮ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ হয় । সেই তালিকায় ছিল বহরমপুর, কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, বর্ধমান-পূর্ব, বর্ধমান-দুর্গাপুর, আসানসোল, বোলপুর ও বীরভূম । গত লোকসভা ভোটে এই কেন্দ্রগুলিতে ফলাফল কেমন ছিল দেখে নেওয়া যাক...
বহরমপুর । অধীর গড় বলা হয় । পাঁচ বারের সাংসদ তিনি । ২০১৯-এও ৫ লাখ ৯১ হাজার ১৪৭ ভোট পান অধীর । প্রতিপক্ষ ছিলেন তৃণমূলের অপূর্ব সরকার । তবে এবার তাঁকে কড়া টক্কর দিচ্ছেন জনপ্রিয় ক্রিকেট তারকা ইউসুফ পাঠান । ২০১৯ সালে কৃষ্ণনগর থেকে তৃণমূলের টিকিটে ৬,১৪,৮৭২ ভোট পেয়ে সাংসদ হন মহুয়া মৈত্র । কিন্তু, গত বছরই সাংসদ পদ খারিজ হয় মহুয়ার । তবে, এবারও ওই কেন্দ্র থেকে প্রার্থী করা হয়েছে তাঁকে । তাই এবার কৃষ্ণনগরে প্রেস্টিজ ফাইট তৃণমূলের ।
রানাঘাট ও বর্ধমান-দুর্গাপুর বিজেপির দখলে রয়েছে । ৭,৮৩,২৫৪ ভোট পেয়ে রানাঘাট থেকে জেতেন জগন্নাথ সরকার । বর্ধমান-দুর্গাপুরে ৫,৯৮,৩৭৬ ভোট পান এসএস আহলুওয়ালিয়া । এই দুই কেন্দ্র থেকে বিজেপির টিকিটে প্রার্থী হয়েছেন যথাক্রমে জগন্নাথ ও দিলীপ ঘোষ । তৃণমূলের অধীনে রয়েছে বর্ধমান পূর্ব । ৬,৪০,৮৩৪ ভোট পান সুনীল কুমার মণ্ডল । এবার সেখানে তৃণমূলের প্রার্থী শর্মিলা সরকার ।
আসানসোল । ২০১৯-এ বিজেপির টিকিটে লড়ে ৬,৩৩,৩৭৮ ভোট পেয়ে সাংসদ হন বাবুল সুপ্রিয় । কিন্তু, সাংসদ থাককালীন দল বদল করে তৃণমূলের যোগ দেন বাবুল । ফলে ২০২২-এ এই কেন্দ্রে ফের উপনির্বাচন হয় । শত্রুঘ্ন সিনহাকে প্রার্থী করে এই কেন্দ্রের দখল নেয় তৃণমূল । এবার আসানসোলে দলের পছন্দের প্রার্থী শত্রুঘ্ন সিনহা । বোলপুর ও বীরভূম রয়েছে তৃণমূলের দখলে । গত বার বোলপুর থেকে ৬,৯৯,১৭২ ভোট পেয়ে সাংসদ হন তৃণমূলের অসিত কুমার মাল । বীরভূমের সাংসদ শতাব্দী রায় । ৬,৫৪,০৭০ ভোট পেয়েছিলেন তিনি । এবারও তাঁরা প্রার্থী হয়েছেন ওই দুই কেন্দ্রে ।
পঞ্চম দফা, ৭ কেন্দ্র । নজরে বনগাঁ, ব্যারাকপুর, হাওড়া, উলুবেড়িয়া, শ্রীরামপুর, হুগলি,আরামবাগ । বনগাঁ থেকে ৬,৮৭,৬২২ ভোট পান বিজেপির শান্তনু ঠাকুর । এবারও ওই কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী তিনি । ব্যারাকপুর ও হুগলিও বিজেপির দখলে । ৪,৭২,৯৯৪ ভোট পেয়ে ব্যারাকপুর থেকে জেতেন অর্জুন সিং । আর হুগলি থেকে জেতেন লকেট চট্টোপাধ্যায় । প্রাপ্ত ভোট ৬,৭১,৪৪৮ । হাওড়া, উলুবেড়িয়া, শ্রীরামপুর ও আরামবাগ রয়েছে তৃণমূলের দখলে । এই কেন্দ্রগুলি থেকে জিতেছিলেন যথাক্রমে প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় (৫,৭৬,৭১১),সাজদা আহমেদ (৬,৯৪, ৯৪৫), কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় (৬,৩৭,৭০৭),অপরূপা পোদ্দার (৬,৪৯,৯২৯)
ষষ্ঠ দফায় নজরে ছিল তমলুক,কাঁথি, ঘাটাল,ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও বিষ্ণুপুর । এই কেন্দ্রগুলির মধ্যে তমলুক,কাঁথি, ঘাটাল তৃণমূলের দখলে ছিল । এই কেন্দ্রগুলি থেকে জিতেছিলেন দিব্যেন্দু অধিকারী (৭,২৪,৪৩৩), শিশির অধিকারী (৭,১১,৮৭২), দীপক অধিকারী (দেব)(৭,১৭,৯৫৯) । উল্লেখ্য, চলতি বছরই লোকসভা ভোটের আগে বিজেপিতে যোগ দেন দিব্যেন্দু । এবার ওই কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী দেবাংশু ভট্টাচার্য । কাঁথিতে তৃণমূলের টিকিটে প্রার্থী হয়েছেন উত্তম বারিক । আর দেব এবার হ্যাটট্রিকের লক্ষে রয়েছেন ।
বিজেপির দখলে বাকি কেন্দ্রগুলি, অর্থাৎ ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও বিষ্ণুপুর । এই কেন্দ্রগুলি থেকে জেতেন যথাক্রমে কুনার হেমব্রম (৬,২৬, ৫৮৩), দিলীপ ঘোষ (৬,৮৫,৪৩৩), জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো (৬,৬৮,১০৭), সুভাষ সরকার (৬,৭৫,৩১৯), সৌমিত্র খাঁ ( ৬,৫৭,০১৯) ।
সাত দফায় ভোট হয়েছে ৯ কেন্দ্রে । যার প্রতিটা কেন্দ্রই গতবার তৃণমূলের দখলে ছিল । কোন কেন্দ্রে কোন প্রার্থী কত ভোটে জিতেছিলেন, দেখে নিন একনজরে ...
দমদম- সৌগত রায়, প্রাপ্ত ভোট ৫,১২,০৬২
বারাসত - কাকলি ঘোষদস্তিদার, প্রাপ্ত ভোট ৬,৪৮,৪৪৪
বসিরহাট - নুসরত জাহান , প্রাপ্ত ভোট ৭,৮২,০৭৮
জয়নগর - প্রতিমা মণ্ডল, প্রাপ্ত ভোট ৭,৬১,২০৬
মথুরাপুর - চৌধুরী মোহন জাটুয়া, প্রাপ্ত ভোট ৭,২৬,৮২৮
ডায়মন্ড হারবার - অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাপ্ত ভোট ৭,৯১,১২৭
যাদবপুর - মিমি চক্রবর্তী, প্রাপ্ত ভোট ৬,৮৮,৪৭২
কলকাতা দক্ষিণ- মালা রায়, প্রাপ্ত ভোট ৫,৭৩,১১৯
কলকাতা উত্তর - সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাপ্ত ভোট ৪,৭৪,৮৯১