লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণে (Lata Mangeshkar Passes Away) শোকস্তব্ধ গায়িকা আরতী মুখোপাধ্যায় (Arati Mukherjee)। জানালেন তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। তাঁর নিজের গানের জীবনের শুরুটা ওনার হাতেই হয়েছিল। পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীও (Pandit Ajiy Chakraboty) মর্মাহত। জানালেন, গান শব্দটা স্বার্থকতা পেয়েছে লতা মঙ্গেশকরের জন্যই। শ্রদ্ধা জানালেন শিল্পী রাঘব চট্টোপাধ্যায়ও।
আরতী মুখোপাধ্যায়
"লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে আমার অনেক ছোটবেলা থেকে যোগাযোগ। মনে হয় বছর ১৪, এরকম আমার বয়স ছিল। আমি অল ইন্ডিয়াতে ফাস্ট হয়েছিলাম। আমাদের বিচারকরা ছিলেন বড় বড় মিউজিক ডিরেক্টর। নওশাদ আলি, মদনমোহন, অনিল বিশ্বাস, বসন্ত দেসাই, সি রামচন্দ্র। তখনকার সেরা মিউজিক ডিরেক্টর সব। তাঁরা আজও বিখ্যাত সুরকার। লতাদি ওঁদের সঙ্গে অনেক গেয়েছেন। তিনি তখন একজন বিরাট ব্যক্তিত্ব। সেই সময় থেকে যোগাযোগ। আমি খুব ছোট্টবেলা থেকে ওঁর গান শুনতাম। অন্যান্য শিল্পীদেরও শুনেছি। কিন্তু ওঁর গান সাংঘাতিক ভাবে ছুঁয়ে যেত। আমি একবেলা না শুনলে, কান্না পেয়ে যেত। এরকম একটা ব্যাপার ছিল। তখন রেডিওটাই মাধ্যম ছিল। খুলে রাখতাম, পড়তাম গান শুনতে শুনতে। সেই জীবনটা কাটিয়ে এসেছি। আমি আবার সেই প্রফেশনেই এসেছি। তখন আমি ওঁর সঙ্গে গেয়েছি। উনি আমাকে শিখিয়েওছেন। প্লে-ব্যাক করা, শব্দটাকে কীভাবে সুরের সঙ্গে কাব্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া যায়। সুর, কাব্য যাতে এক থাকে। প্লে-ব্যাক করাটা কিন্তু খুব সোজা নয়। সিচুয়েশেন, সিকোয়েন্স ধরতে হয়। সেগুলো মাথায় রেখে গানটা করা। এই ধরনের ছোট ছোট কথাগুলো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে বোঝাতেন। সেটা আমার পরম আনন্দের দিন ছিল। সারাদিন ওনার সঙ্গে কাটিয়েছি। একদিনে দুটো তিনটে করে রেকর্ডিং করেছি। সেটাও দেখেছি ছোট্ট বয়সে, উনি কেমন করে গাইছেন। এরকম একটা ব্যক্তিত্বের সঙ্গে দিনের পর দিন থাকা, এটাই তখন আমার কাছে আনন্দের। জীবনের শুরুটাই ওনার হাত ধরে এসেছি, এরকম মনে হত। গানকে কীভাবে তুলে ধরতে হয় শেখাতেন।"
আরও পড়ুন: ৯০ বছরে শেষ প্লে-ব্যাক, হেমা থেকে লতার হওয়ার রূপকথা
পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী
"সূর্যপতন, ইন্দ্রপতন, চন্দ্রপতন যাই বলি না কেন, যেরকম মানুষের মনে প্রভাব বিস্তার করে- নক্ষত্রপতন। ওঁকে শুধু নক্ষত্র বললে হয় না। গান শব্দটা স্বার্থকতা পেয়েছে ওঁর অভ্যুত্থানে। ওঁর যে পরিচিত হওয়া মানুষের কাছে, তার মাধ্যমে সঙ্গীত শব্দের অনেক পরিচয় পরিবর্তিত হয়েছে। সঙ্গীত, আমরা গান করি, আমরা গান শিখি, গাই গাই, পরিচিত হই। তা যদি স্বর্গের স্ঙ্গে তুলনা করা যায়, সেইখানে একটা বিষয়ে- সব বিষয় আমি বলতে পারছি না। কারণ খেয়াল গানের বা ধ্রুপদ গানের পোগ্রাম করতেন না। কিন্তু সবার মনে নাসিরুদ্দিন খাঁ সাহেব, ফৈয়াজ খাঁ সাহেব, ভিডি পালুষকরজি -সব্বাই লতা মঙ্গেশকরের গানের অত্যন্ত ভক্ত ছিলেন এবং ভালবাসতেন। সমস্ত শিল্পীরা লতা মঙ্গেশকরকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ শিল্পী বলে মেনেছেন। তার কথা আমি আর কী বলব। সূর্যকে প্রদীপ দিয়ে দেখানোর কোনও প্রয়োজন হয় না। একটাই জিনিস। উনি যে উদাহরণ রেখে গেলেন, সেই উদাহরণ যে কী, সেটা কত পরিশ্রম, কত নিজেকে শেখানো, কত স্ট্রাগল এর মাধ্যমে লতা মঙ্গেশকর হয়েছেন। ওঁর জীবনীটা যেন আমরা পড়ি। এটা আমাদের সবথেকে বেশি প্রয়োজন। আজকের দিনে ওরকম স্ট্রাগলিং করার মানসিকতা না হলে কেউ ওই জায়গায় যাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না। ওর আত্মাকে কোটি কোটি প্রণাম। পৃথিবীর নিয়মে শরীরকে তো যেতেই হয়।"
রাঘব চট্টোপাধ্যায়
'গতকাল আমরা সরস্বতী পুজো করলাম। রাত্রিবেলা অনুষ্ঠানও ছিল। আজকে মনে হল এই প্রথম বোধ হয় মা সরস্বতীর বিসর্জন হল। এরকম একজন মানুষ, যাকে আমরা ভগবানের মতো চিরকাল দেখে এসেছি। ভারত তথা পৃথিবীর ইতিহাসে সঙ্গীত যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন লতা মঙ্গেশকরের নামটাও থাকবে। ওঁকে শুধু গায়িকা হিসেবে নয়, বিরাট বড় সঙ্গীতশিক্ষিকা হিসেবে মানতাম। প্রতি মুহূর্তে আমরা তাঁর গানে নানাভাবে অনুপ্রেরিত হই। কতকিছু প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে শিখেছি। কলকাতা ও বম্বেতে আমি কয়েকবার দেখা করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। সেই সব দিনগুলো, সে সময় স্টেজে হাতে ধরে তুলেছিলাম। স্টেজ থেকে নামার সময় সাহায্য়ের হাত দেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। এই জিনিসগুলো মনে পড়ছে। এই গানগুলো সমস্ত সঙ্গীতজ্ঞদের কাছে, প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর কাছে অমর হয়ে থাকবে। যে গানগুলো থেকে আমরা প্রত্যেক লাইন থেকে শিখতে পারব। গান কী করে গাইতে হয়, সুরে কী করে গাইতে হয় শিখতে পারব। লতা মঙ্গেশকর আর কোনও দিন কেউ হবে না। আর কোনও দিনও পুর্নর্জন্ম সম্ভব নয়।'