১৯৯২ সালের ২৫ জুন। মুক্তি পেল ঋষি কাপুর ও দিব্যা ভারতী অভিনীত এবং গুড্ডু ধানোয়া প্রযোজিত এবং রাজ কানোয়ার পরিচালিত ছবি 'দিওয়ানা'। ছবির কাহিনি নব্বই দশকের বলিউডের দর্শক যে মেইনস্ট্রিম ঘরানার সিনেমায় অভ্যস্ত ছিল, তার থেকে কিছুটা আলাদা। এ তো গেল একটা দিক। কিন্তু, এছাড়া আরও একটি ব্যাপার রয়েছে। এই ছবিতে প্রথমবার বলিউডের দর্শক দেখল ২৬-২৭ বছরের এক তরুণকে। যাঁর চেহারার গড়ন তৎকালীন বলিউডের নিরিখে একেবারেই 'হিরোসুলভ' নয়। তাঁর অভিনীত চরিত্রটিও একেবারেই নায়কের নয়! তার থেকেও অনেক বেশি করে 'অ্যান্টি-হিরো' সুলভ। অথচ, সিনেমার শেষে দর্শকের মন জয় করে নিল ওই তরুণের অভিনীত চরিত্রটিই। তরুণের নাম? শাহরুখ খান!
সেই শুরু! প্রথম ছবিতে অ্যান্টি-হিরোর ধরনের চরিত্র করে মন জিতলেও প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমায় অ্যান্টি-হিরো আসলে ছিলেন না তিনি। তবে, তাঁর ঠিক এক বছর বাদেই যে দুটি সিনেমা রিলিজ করেছিল, সেই 'ডর' এবং 'বাজিগর'-এ অ্যান্টি-হিরোর ভূমিকাতেই অভিনয় করেছিলেন কিং খান! প্রথমে নভেম্বরে 'বাজিগর' এবং তার পরের মাসে ডিসেম্বরে 'ডর'। মজার ব্যাপার, এই দুটি ছবিতেই নায়কের ভূমিকায় প্রথম পছন্দ ছিলেন না শাহরুখ। সঞ্জয় দত্ত থেকে অজয় দেবগণ সকলের কাছেই অফার গিয়েছিল 'রাহুল'-এর ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য। অফার গিয়েছিল আমির খানের কাছেও। আমির রাজি হয়েই গিয়েছিলেন প্রায়। তবে, শেষ মুহূর্তে পরিচালক যশ চোপড়ার সঙ্গে মতের অমিল হওয়ায় প্রোজেক্ট থেকে তিনি বেরিয়ে আসেন। তারপরই রোলটির অফার যায় শাহরুখ খানের কাছে। সেই অফার তিনি গ্রহণ করেন। তারপর কী হয়েছিল, তা প্রতিটি বলিউড অনুরাগীই জানেন খুব ভালভাবে।
প্রায় একইরকম ব্যাপার ঘটেছিল আব্বাস-মস্তানের 'বাজিগর' ছবির ক্ষেত্রেও। অক্ষয় কুমার, অনিল কাপুর থেকে সলমন খান- সকলেই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এই চরিত্র। নিজেদের কেরিয়ারের সেরা সময়ে কেউই হাড়হিম করা 'অ্যান্টি-হিরো'-র চরিত্রে অভিনয় করতে রাজি হননি। সেই রোলও গ্রহণ করলেন শাহরুখ খান। ১৯৯৩ সালে অ্যান্টি-হিরোর ভূমিকায় শাহরুখের এই দুটি ছবিতে অভিনয় এবং বক্স-অফিসে চূড়ান্ত সাফল্য বদলে দিল দীর্ঘদিন ধরে লালন করে চলা এক চিরাচরিত ধারণাকে। যা, অন্তত তার আগে ঠিক এইভাবে হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে কখনও ধরা পড়েনি। কী সেই ধারণা? তথাকথিত 'নায়কসুলভ' চেহারা নয়, এমন কেউও অ্যান্টি-হিরোর ভূমিকায় অভিনয় করে নায়কের থেকেও অনেক বেশি করে মন জয় করে নিতে পারেন আপামর দর্শকদের।
ঠিক এর পরের বছর ১৯৯৪ সালে 'অঞ্জাম' ছবিতে 'অ্যান্টি-হিরো'র ভূমিকায় অভিনয় করে 'ভিলেন'-এর ভূমিকার জন্য ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পান শাহরুখ খান ১৯৯৫ সালে। যে পুরস্কার তাঁর আগে আর কোনও প্রথমসারির নায়ক পাননি বলিউডে।
বস্তুত, ১৯৯৫ সালে 'দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে' মুক্তি পাওয়ার আগে অ্যান্টি-হিরোর ভূমিকাতেই বলিউডে নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন মীর তাজ মহম্মদ খান এবং লতিফ ফতিমা খানের পুত্র। তাঁর চিরাচরিত 'প্রেমিক' সত্তা সর্ষেখেতে দু'হাত টান করে দাঁড়িয়ে পোজ দেওয়ার মাধ্যমে শুরু হলেও, আসলে শাহরুখ নিজেও বারবার ভালবেসেছেন পর্দায় নিজের 'অ্যান্টি-হিরো' সত্তাকেই। পরবর্তীকালে 'জোশ' সিনেমায় তার ঝলক দেখা গেলেও আবার সেই অ্যান্টি-হিরো দুর্দান্তভাবে ফিরে এসেছিলেন ফারহান আখতারের 'ডন'-এ। কিন্তু, বাজারের দায় বড় দায়! শাহরুখ নিজে নিজেকে বড়পর্দায় যেভাবেই দেখতে চান না কেন, বাজার তো চায় সেই প্রেমিক শাহরুখকেই! সেই রাহুল বা রাজ আরিয়ান মালহোত্রাকেই। যার প্রভাব পড়েছিল, সিনেমার বিষয়তেও।
তবে, সেই ধারা শেষমেশ বদলালেন শাহরুখ নিজেই! প্রায় দেড় দশক বাদে। 'হ্যাপি নিউ ইয়ার'-এর পর তাঁর ড্রিম প্রোজেক্ট 'জিরো' পর্যন্ত কোনও ছবিই ব্লকবাস্টার হয়নি। চার বছর বড় পর্দায় আসেননি তিনি। সমালোচকরা বলেছিলেন, ফুরিয়ে গিয়েছেন কিং খান। অনুরাগীরাও ছিলেন দোলাচলে। একের পর এক ফ্লপ থেকে ব্যক্তিগত জীবনের নানা টানাপড়েনে শাহরুখ খান কার্যত বিধ্বস্ত- এমনটাই ভেবেছিলেন অজস্র বলিউড ও শাহরুখ-ভক্ত। আর কি কখনও সেই একইভাবে পর্দায় ঝড় তুলতে পারবেন 'বাদশা'? সমস্ত আশা ও আশঙ্কাকে আরব সাগরের জলে ফেলে দিয়ে বক্স-অফিসে রেকর্ড গড়ে ফিরে এলেন শাহরুখ খান! ২০২৩ সালে। প্রথমে 'পাঠান' এবং পরে 'জওয়ান'-এ। সেই 'অ্যান্টি-হিরো'র চরিত্রেই। দুটি ছবিই বক্স-অফিসে ব্যবসা করল এক হাজার কোটি টাকার বেশি।
সাফল্য তাঁর কাছে খুব মসৃণভাবে আসেনি। কোনও 'গডফাদার' ছাড়াই মুম্বইতে অভিনেতা হিসেবে নিজের জায়গা তৈরি করা। তারপর নিজেকে প্রথমে এক নম্বর নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা এবং তারপর দুনিয়ার ধনীতম অভিনেতাদের তালিকায় নাম- প্রায় রূপকথার মতো উত্থান শাহরুখ খানের। কেউ তাঁকে বলেন স্বপ্নে পাওয়া রাজপুত্তুর, কেউ বা বলেন বিনোদন জগতের শেষতম তারকা। এই দুইয়ের মিশেলেই তিনি কিং। অজস্র অগণিত ভারতীয়'র হৃদয়ের মানসপুত্র। তিন দশক ধরে তাঁর যে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, টোল পড়া হাসি আর প্রসারিত দুই বাহু ভালবাসা বিলিয়েছে অনর্গল। চার বছর পর বড় পর্দায় ফিরে শাহরুখ খান বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, সমস্ত বিদ্বেষকে হেলায় উড়িয়ে শেষমেশ টিকে থাকে তাঁর সেই তীব্র প্যাশনই। যা জীবনের। যা শিল্পেরও। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ভালবাসা যদি সংক্রামক হয়, তবে তা ঘৃণাকে কমজোরি করে দিতে পারে। কেরিয়ারের শুরু থেকেই প্রতিবার নিজের মতো করে ছক ভেঙেছেন। বলিউডে তিন দশক পার করেও সেই ছকভাঙার ট্র্যাডিশন একইরকম অমলিন।