মৃণাল সেন- নামটির সঙ্গে ভীষণভাবে জড়িয়ে আছে এক অন্য সময়, এক অন্যরকম কলকাতার গন্ধ। যে কলকাতায় বহু মানুষের চোখে ছিল দিনবদলের স্বপ্ন, আটপৌরে মধ্যবিত্ততায় মিশে ছিল ভীষণ স্মার্ট আর্ন্তজাতিকতা। যে কলকাতার নিজের মাটিতে দাঁড়িয়ে কথা বলত গোটা বিশ্বের সঙ্গে। টাকাপয়সার ঝনঝনানি নয়, মেধার ঊৎকর্ষের মূল্য বেশি ছিল যে তিলোত্তমায়, তারই বাসিন্দা ছিলেন মৃণাল সেন।
কেউ তাঁকে বলেন 'সংলাপের জাদুকর', কেউ বলেন 'পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখানো সবথেকে বলিষ্ঠ চোখ'। প্রথম ছবি 'রাতভোর' থেকে শেষ ছবি 'আমার ভুবন' পেরিয়েও যাঁর মনন ও কাজের বিস্তার দিগন্তবিস্তৃত। সত্যজিতের সৃজন-ভাবনার বিপরীত বিন্দু থেকেই তাঁর ছবি করা শুরু। বাংলা চলচ্চিত্রকে 'ক্লাসিক'করে তোলার দায়ে বিশ্বাস ছিল না তাঁর। শিল্পেও সোচ্চার ছিলেন বরাবর।
সিনেমায় আধুনিকতার নিরিখ কী, খুঁজে বেড়িয়েছেন পরিচালক। আসলে খুঁজে বেড়িয়েছেন নিজের জমি। যে জমির মাটি একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়েছে 'বাইশে শ্রাবণ' থেকে 'অন্তরীণ', 'কলকাতা ৭১' থেকে 'ইন্টারভিউ', 'ভুবন সোম' 'পদাতিক'-এ।
কিংবদন্তি চিত্রপরিচালক মৃণাল সেন, এমন একজন স্রষ্টা, যিনি বিশ্বাস করতেন কম খরচে ভালো ছবি তৈরি করা সম্ভব। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে উপভোগ করতেন তিনি৷ ছেলে কুণালের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল বন্ধুর। মৃণাল সেনের সিনেমার শুটিংয়ে একসঙ্গে পাত পেড়ে খেতেন সবাই- পরিচালক, নায়ক থেকে শুরু করে কলাকুশলীদের প্রত্যেকে৷ উঁচুনিচুর ভেদ ছিল না সেখানে। সাম্যের আদর্শে মৃণাল সেনের বিশ্বাস মিশে ছিল তাঁর যাপনে, প্রাত্যহিকতায়। সিনেমার সেটই বা তার ব্যক্তিক্রম হবে কেন?
'ইন্টারভিউ’, ‘খণ্ডহর’, ‘পুনশ্চ’, ‘মহাপৃথিবী’, ‘ভুবন সোম’, ‘পদাতিক’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর মতো ছবিতে মৃণাল তাই বার বার বলতে চেয়েছেন সাধারণ মানুষের কথা। যে মানুষ ক্লান্ত, যার কিছুই তেমন করা হয়ে উঠছে না জীবনে, যে নিয়ত লাঞ্ছিত, ধ্বস্ত, সেই মানুষের উপরও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় মৃণালের ছবি দেখলে।
পা থেকে মাথা পর্যন্ত একজন আর্ন্তজাতিক মানুষ ছিলেন মৃণাল সেন। সমকালীন বিশ্বের তাবড় তাবড় পরিচালকরা ছিলেন তাঁর কাজের অনুরাগী। অথচ তাঁর শিকড় ছিল কলকাতার গভীরে প্রোথিত৷ এই শহরের পিচের রাস্তায় সাদা পাাজামা পাঞ্জাবি পরা মৃণালের শুয়ে পড়ার দৃশ্যটি বাংলা সিনেমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞাপন। খানিকটা প্রতীকিও বটে। এই কলকাতা শহরের হাসি, রাগ, অভিমান, কান্না ও আপস যিনি ধারণ করেছেন সিনেমা, তাঁকেই তো মানায় এমন ছবিতে।
১৯২৩ সালের ১৪ মে জন্মেছিলেন মৃণাল সেন। তাঁর সময়কে তিনি ধারণ করেছেন সিনেমায়। সে এক আশ্চর্য সময়৷ যুদ্ধ, দেশভাগ লাঞ্ছিত ক্রান্তিলগ্ন এক৷ সাম্যের স্বপ্ন বার বার উড়াল দিচ্ছে আকাশে আর ধাক্কা খেয়ে আছড়ে পড়ছে রাজপথে৷ ক্ষুব্ধ ও স্বপ্নবাজ বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনকে তাঁর ১০১ তম জন্মদিনে শ্রদ্ধা।