৯০-এর দশক । বাংলা সিনেমায় তখন চুটিয়ে অভিনয় করছেন দেবশ্রী রায়, শতাব্দীরা । তাপস পাল, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে জুটি বেঁধে একের পর এক হিট ছবি উপহার দিচ্ছেন । সেইসময় টলিউডে এন্ট্রি হল ২০-২২ বছরের একটি মেয়ে-র । ছিপছিপে গড়ন, মুক্ত ঝরা হাসি, মোহময়ী চাহনি, কাজল টানা চোখ...প্রথম সিনেমাতেই নজর কাড়লেন । পুরুষের হৃদয়ে হিল্লোল তুললেন নতুন নায়িকা । ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত । দেবশ্রী, শতাব্দীদের পাশে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিতে শুরু করলেন অভিনেত্রী । বছর কয়েকের মধ্যে টলিউডের প্রথম সারির নায়িকার তালিকায় জায়গা করে নিলেন । নায়িকা থেকে হয়ে উঠলেন 'মহানায়িকা' । ৩৫ বছরের কেরিয়ারে প্রায় ৯০ টি সিনেমা তাঁর ঝুলিতে । আজ সেই টলি কুইন ঋতুপর্ণার জন্মদিন । পঞ্চাশের গন্ডি পেরিয়েছেন বছর তিনেক আগেই । অথচ, ঋতুপর্ণাকে দেখে বোঝার উপায় নেই । ৫৪-র ঋতু যেন রুপোলি পর্দার চিরদিনের তন্বী । তাঁর সৌন্দর্য্য, তাঁর ব্যক্তিত্ব 'অনন্যা' করে তুলেছে সবসময় ।
ধারাবাহিক থেকে কেরিয়ার শুরু করেছিলেন ঋতুপর্ণা । ১৯৮৯ সালে ধারাবাহিক 'শ্বেত কপোত'-এ তাঁর প্রথম কাজ । আর সিনেমায় হাতেখড়ি প্রভাত রায়ের হাত ধরে । সালটা ১৯৯২ । 'শ্বেত পাথরের থালা' সিনেমা দিয়ে টলিউডে আত্মপ্রকাশ । তারপর 'নাগপঞ্চমী'-তে জুটি বাঁধলেন প্রসেনজিতের সঙ্গে । টলি ইন্ডাস্ট্রি পেল এভারগ্রিন জুটি । তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ঋতু-কে । অভিনেত্রীর ঝুলি ভরল 'দহন', 'পারমিতার একদিন', 'উৎসব', 'আলো', 'চাঁদের বাড়ি', 'চতুরঙ্গ'-এর মতো মাস্টার পিস-এ ।
সিনেমার চরিত্র হোক কিংবা পোশাক...সবেতেই সাহসী, ছক ভাঙা ঋতুপর্ণা । কখনও বিকিনি পরে বোল্ড লুকে ঝড় তুলেছেন, কখনও আবার সাবেকি লুকে অভিনেত্রী হিল্লোল তুলেছে মানুষের মনে । তবে,৩৫ বছরের কেরিয়ারে ঋতুপর্ণাকে নিয়ে কম বিতর্ক নেই । কখনও তাঁর প্রেমজীবন নিয়ে চর্চা চলেছে, কখনও অভিযোগ উঠেছে স্বজনপোষণের, কখনও আবার নাম জড়িয়েছে দুর্নীতিতে ।
প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা
প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণার সম্পর্কের সমীকরণ একটা সময় পেজ থ্রি-র হট টপিক ছিল । এখনও তাঁদের নিয়ে চর্চা চলে টলি অন্দরে । তিন দশক রূপোলি পর্দায় রাজ করেছে ঋতুপর্ণা ও প্রসেনজিৎ জুটি । নাগপঞ্চমী তাঁদের প্রথম ছবি । দর্শকদের মনে রাতারাতি জায়গা করে নিয়েছিলেন ঋতু-প্রসেনজিৎ জুটি । ৯০-এর দশকে প্রসেনজিতের ছবি মানেই নায়িকা ঋতুপর্ণা । অনেকে বলেন, উত্তম-সুচিত্রার পর বাংলার দর্শকদের মনে দাগ কেটেছে জনপ্রিয় জুটি প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা ।
টলিপাড়ায় এও গুঞ্জন রয়েছে, প্রসেনজিৎ ও ঋতুপর্ণা নাকি গোপনে প্রেম করতেন । তাঁদের অনস্ক্রিন কেমিস্ট্রি দেখে মনে হত বাস্তবেও যেন তাঁরা প্রেমিক-প্রেমিকা । একেবার যাকে বলে মেড ফর ইচ আদার । টলিপাড়ায় গুঞ্জন, বাস্তবে তাঁরা সত্যিই একে অপরকে মন দিয়ে ফেলেছিলেন । বাংলার দর্শকদের কাছে এখনও বড় রহস্য এটাই যে, সত্যিই কি তাঁরা প্রেমে পড়েছিলেন ?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ঋতু তাঁর থেকে অনেকটা ছোট । যখন ১৯৯৪-এ প্রথম এক ছবিতে কাজ করেছিলেন, তখন ঋতু সবে কাজ করা শুরু করেছে । একদম নতুন । সেই ছবি (নাগপঞ্চমী) ফিফটি উইক চলেছিল । তারপর একটা ব্যক্তিগত কারণে আড়াই-তিন বছর কাজ করেননি প্রসেনজিৎ । তারপর ফিরে এসে আবার ঋতুর সঙ্গে কাজ করেছেন । তখনকার দিনে ভালে কাজ করলে রটে যেত। একটা বাজ তৈরি হত । তবে, প্রেম হয়েছিল কি না সেটা রহস্যই রাখতে চেয়েছেন প্রসেনজিৎ ।
বুম্বা দা জানিয়েছেন, প্রেম হয়েছিল কি না এটা রহস্যই থাক । প্রেমের সবসময় সহজ ব্যাখ্যা হয় না । প্রেমের ক্ষেত্রে সবসময় দুয়ে দুয়ে চার করা যায় না । কিন্তু একটা কেমিস্ট্রি তো নিশ্চয়ই আছে । দর্শক তাঁদের প্রেম দেখতে চায় । তাঁদের বিশ্বাসটা বিশ্বাসের জায়গাতেই থাকুক । ঋতুপর্ণার গলাতেও একই সুর শোনা গিয়েছে । এক সাক্ষাৎকারে ঋতু জানিয়েছিলেন, ২৪ ঘণ্টা একটা মানুষের সঙ্গে থাকলে, কাজ করলে, একটা ভালবাসা, নির্ভরতা তো তৈরি হয় । তবে কি এই ভালবাসা প্রেম নয়? এই উত্তর তিনি দেবেন না, এই প্রশ্নের উত্তর রহস্যই থাক । মানুষ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াক যুগ যুগ ধরে ।
তবে, ২০০২ সালে হঠাৎ কাজ করা বন্ধ করে দিলেন প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা । প্রায় ১৪ বছর একসঙ্গে কাজ করেননি । টলিপাড়ায় গুঞ্জন, মুখ দেখাদেখিও নাকি বন্ধ ছিল । কী হয়েছিল দু' জনের মধ্যে ? প্রসেনজিৎ জানিয়েছেন, তাঁরা ঠিক করেছিলেন কিছুদিন তাঁরা একসঙ্গে কাজ করবেন না । ঠিক ঝগড়া নয়, প্রায়ই মান-অভিমানের পালা চলত দু'জনের মধ্যে । প্রসেনজিৎ জানান, একটা পয়েন্ট পেরনোর পর মনে হয়েছিল, দু'জনেই ম্যাচিওর, ভাল প্রোজেক্ট এলে কাজ করা উচিত । তারপরই 'প্রাক্তন'-এ কামব্যাক করলেন প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা । ২০২৪-এ মুক্তি পেয়েছে প্রসেনজিৎ-ঋতু জুটির ৫০ তম ছবি । তবে, জানেন কি বর্তমানে তো আবার প্রসেনজিতের ছেলে মিশুক ও ঋতুপর্ণার মেয়ে ঋষণার বিয়ে নিয়েও গুঞ্জন ছড়িয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায় ।
ঋতুপর্ণা-সঞ্জয়
ব্যক্তিগত জীবন বরাবরই ব্যক্তিগত রাখতেই পছন্দ করেন ঋতুপর্ণা । ১৯৯৯ সালে সঞ্জয়ের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন ঋতুপর্ণা । সঞ্জয় নাকি ঋতুর ছোটবেলার প্রেম । আর্ট স্কুলে তাঁদের প্রথম দেখা । একটা এক্সকারসানে গিয়েছিলেন । তখন ঋতুর ক্লাস সেভেন, আর সঞ্জয়ের ক্লাস টেন । প্রথম দেখাতেই ভাললাগা, যাকে বলে লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট । তারপর তো চিঠি দেওয়া-নেওয়া, ফোনে প্রেমালাপ । তবে, কাজের প্রয়োজনে দু'জনের পথ আলাদা হয়ে যায় । সঞ্জয় উচ্চশিক্ষার জন্য় চলে যান আমেরিকা । আর ঋতুপর্ণা শহরে, চুটিয়ে তখন সিনেমা করছেন । ১৯৯৭ সালে আবার তাঁদের দেখা হল, কথা হল, প্রেম আবার জমল । তারপর ১৯৯৯ সালে সোজা ছাদনাতলায় । ২০০০ সালে তাঁদের জীবনে আসে ছেলে অঙ্কন । ২০১১ সালে তিন থেকে চার হন তাঁরা । ঋতুপর্ণার কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে কন্যাসন্তান রিষনা নিয়া চক্রবর্তী । ঋতুপর্ণা শুধু এখন অভিনেত্রী নন, একজন স্ত্রী, দুই সন্তানের মা-ও বটে ।
স্বজনপোষণের অভিযোগ
ঋতুপর্ণার বিরুদ্ধে বারবার স্বজনপোষণের অভিযোগ উঠেছে । প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণার জন্য নাকি বহু অভিনেতা কাজ হারিয়েছেন । প্রয়াত অভিনেতা অভিষেক চট্টোপাধ্যায়ও বহু বছর আগে হিট জুটির দিকে আঙুল তুলেছিলেন । নাম না করে অভিষেক অভিযোগ করেছিলেন, প্রসেনজিৎ, ঋতুপর্ণার জন্যই টলিউডে তিনি তাঁর জায়গা হারিয়ে ফেলেছিলেন । সেভাবে কাজই পাননি । এমন অভিযোগ শুধু অভিষেক নয়, আরও অনেকেই করেছেন । যদিও, ঋতুপর্ণার দাবি, টলিউডে আজ তাঁর যে জায়গা তা নিজের যোগ্যতায় বানিয়েছেন । পরিশ্রম করেছেন, তাই সাফল্য এসেছে । সবাইকে লড়াই করতে হয় । ঋতু জানিয়েছেন, নিজের যোগ্যতায় লড়াই করেছেন । তাই তিনি এই জায়গাটা তৈরি করতে পেরেছেন ।
'দুর্নীতিতে' ঋতু ?
চলতি বছরই রেশন দুর্নীতি মামলায় একাধিকবার তলব করা হয় ঋতুপর্ণাকে । ইডি দফতরেও হাজিরা দিয়েছিলেন ঋতু । ইডি-র এক আধিকারিকের দাবি, রেশন দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার হওয়া এক অভিযুক্তের সঙ্গে প্রায় কোটির অঙ্কে আর্থিক লেনদেন হয়েছে একটি সংস্থার, যার প্রোপ্রাইটর হিসাবে নাম রয়েছে অভিনেত্রীর। এই বিষয়ে কথা বলতেই অভিনেত্রীকে তলব করা হয়েছিল । এই বিষয়ে ঋতুপর্ণা এক সংবাদমাধ্যমকে জানান, ওই সংস্থার সঙ্গে এন্টারটেনমেন্ট কোম্পানি হিসেবে তাঁর কোম্পানি কাজ করেছে । এগজিকিউটিভ প্রডিউসার আর অভিনেত্রী হিসেবে তিনি যুক্ত ছিলেন । ব্যস, এটাই । ইডি সূত্রে খবর, রেশন বণ্টন দুর্নীতি মামলায় ৭০ লক্ষ টাকা ফেরতও দিতে চেয়েছিলেন ঋতুপর্ণা । তবে, রেশন দুর্নীতির আগে ২০১৯ সালে রোজভ্যালি কাণ্ডেও তলব করা হয়েছিল ঋতুপর্ণাকে ।
ঋতুপর্ণা ও বিতর্ক
বিতর্ক যেন ঋতুপর্ণার পিছু ছাড়ে না । দিন কয়েক আগেই আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে সোশ্যাল মিডিয়ায় শাঁখ বাজিয়ে ব্যাপক ট্রোলড হয়েছিলেন টলি কুইন । অনেকে 'নাটক' বলে কটাক্ষ করেছেন । এরপর শঙ্খ বাজানোর ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ডিলিট করে দেন ঋতুপর্ণা । কটাক্ষেরও জবাব দেন টলি কুইন । তাঁর কথায়,'যে ঘটনা কলকাতা বা সারা বিশ্বকে আলোড়িত করেছে এমন একটি ট্র্যাজেডিকে কেন্দ্র করে শঙ্খ বাজানো কোনও নাটক হতে পারে না। বাড়িতে আমার নিজেরও একটা মেয়ে আছে। তাই যদি কেউ মনে করেন, যে আমার কান্না ভেজা চোখে, মেকআপ না করা লুকে শাঁখে ফুঁ দেওয়া নাটক ছিল, তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি আমাদের সমাজে এই ধরনের নৃশংসতার বিরুদ্ধে এটা আমার যুদ্ধ ঘোষণা।'
এখানেই শেষ নয়, আর জি কর কাণ্ডে রাস্তায় প্রতিবাদে নেমে ক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন অভিনেত্রী । তাঁকে ঘিরে গো-ব্যাক স্লোগানও উঠেছিল । এমনকী, ঋতুর উপর হামলার চেষ্টারও অভিযোগ ওঠে । তাঁর গাড়িতে জুতো ছোঁড়া, গাড়িতে হাত দিয়ে মেরে তুবড়ে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ । সেইসময় ঋতুর পাশে দাঁড়িয়েছিল গোটা টলিউড ।
চলতি বছর পুজো কার্নিভ্যালে নৃত্য পরিবেশন করে কটাক্ষের শিকার হতে হয়েছিল ঋতুপর্ণাকে । কেউ বলেছিলেন, ঋতুপর্ণাকে কেউ একটা শঙ্খ দিন । উনি বাজাবেন। আবার অনেকেই ঋতুপর্ণার হেনস্থার দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন । 'চটিচাটা' বলেও কটাক্ষ করা হয়েছিল ।
যদিও, বিতর্ক কখনও ঋতুর কর্মজীবন, ব্যক্তিগত জীবনকে প্রভাবিত করতে পারেনি । হাজারও সমালোচনা, বিতর্ককে দূরে সরিয়ে
এখনও চুটিয়ে কাজ করে চলেছেন । বয়স বাড়ছে ঠিকই । তাঁর ঔজ্জ্বল্য এতটুকু ম্লান হয়নি । তাঁর চোখের চাহনিতেই যেন রয়েছে ভরা আবেদন । যা পুরুষের হৃদয়ে হিল্লোল তোলে । ঋতু যে চিরসবুজ । ওই যে কথায় আছে না এজ ইজ জাস্ট আ নম্বর ।
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে এডিটরজি বাংলার তরফ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা ।