সন্ধে হতেই বাঙালির ড্রয়িংরুমে শুরু হয়ে যায় ব্যস্ততা । সারাদিন কাজের পর কতক্ষণে চা আর মুড়ির বাটিটা হাতে নিয়ে আয়েশ করে টিভির সামনে বসবেন, সেই অপেক্ষাতেই থাকেন বাড়ির মা-ঠাকুমারা । আর এই ধারা আজকের নয়, যুগযুগ ধরে চলে আসছে । আশি-নব্বই দশকের সময় থেকে ধারাবাহিকের ধারাবাহিকতা । তেরো পার্বণ দিয়ে বাঙালির সিরিয়াল দেখার অভ্যাস শুরু । এরপর একে একে মহাপ্রভু, জন্মভূমি, এক আকাশের নীচে-র মতো একাধিক সিরিয়াল বাঙালির হৃদয় ছুঁয়ে নিয়েছে । প্রথম দিকে চ্যানেল বলতে শুধু দূরদর্শন । আর এখন স্টার জলসা, জি বাংলা থেকে কালার্স বাংলা একাধিক চ্যানেলের ছড়াছড়ি । তবে, গত কয়েক বছরে বদলে গিয়েছে সিরিয়ালের ধারা ।
জন্মভূমি-র সময়ের কথাই ধরা যাক । এই এভারগ্রিন সিরিয়াল চলেছিল প্রায় পাঁচ বছর । শুধু কি জন্মভূমি, বছরের পর বছর চলেছে জননী, খেলা, অগ্নিপরীক্ষা, এক আকাশের নীচে-র মতো ধারাবাহিকগুলি । এখনও এই সিরিয়ালগুলি দর্শকদের কাছে সমান প্রাসঙ্গিক । কিন্তু, এখন চ্যানেলের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনই সিরিয়ালগুলির স্থায়ীত্ব কমেছে । দেখা যাচ্ছে একের পর এক ধারাবাহিক দ্রুত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে । কারও বয়স ১ বছর, কারও ১০ মাস, কারও ৭, কারও আবার দুই মাস ।
গত এক-দুই বছরে সিরিয়াল বন্ধের ট্রেন্ড যেন আরও বেড়ে গিয়েছে । সম্প্রতি, জি বাংলার তিনটি সিরিয়াল একসঙ্গে বন্ধ হতে চলেছে । সেই তালিকায় রয়েছে অষ্টমী, আলোর কোলে ও কার কাছে কই মনের কথা ।
অষ্টমী- চলতি বছর এপ্রিলেই শুরু হয়েছিল ধারাবাহিক । সিরিয়ালের প্রোমো প্রকাশ্যে আসতেই দর্শকদের মধ্যে উন্মাদনা ছিল তুঙ্গে ।কিন্তু, সিরিয়ালের দুই মাস পূর্ণ হতে না হতেই সিরিয়াল বন্ধের খবর সামনে আসছে । এই ধারাবাহিক নিয়ে দর্শকদের প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল, যা পূরণ হয়নি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল ।
আলোর কোলে - দর্শকের মনে দাগ কাটতে পারেনি প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের আলোর কোলে ধারাবাহিকটিও । মাত্র ৭ মাসেই বন্ধ হচ্ছে এই সিরিয়াল । কিছুদিন আগেই শুটিং সেট থেকে ছবি দিয়ে মন খারাপের কথা শেয়ার করেছিলেন নন্দিনী ওরফে অভিনেত্রী আয়েশা ভট্টাচার্য ।
কার কাছে কই মনের কথা - পাঁচ অভিনেত্রীর গল্প নিয়ে শুরু হয়েছিল সিরিয়াল 'কার কাছে কই মনের কথা' । মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেন মানালি দে, স্নেহা, বাসবদত্তারা । প্রথমদিকে এই ধারাবাহিক টিআরপিতে সেভাবে প্রভাব না ফেললেও, পরের দিকে প্রায় পাঁচের মধ্যেই থাকত ধারাবাহিক । কিন্তু, একবছর হওয়ার আগেই ধারাবাহিক বন্ধ হচ্ছে । বন্ধুত্বের গান গেয়ে বিদায় নিলেন ধারাবাহিকের কলাকুশলীরা ।
এতো গেল জি বাংলার কথা । স্টার জলসাতেও সম্প্রতি বন্ধ হয়েছে জল থই থই ভালবাসা । মাত্র ৯ মাস আগে শুরু হয়েছিল । স্লটলিডারও ছিল এই ধারাবাহিক । দর্শকদের মনও জয় করে নিয়েছিলেন অপরাজিতারা । তাহলে হঠাৎ কী হল ? সিরিয়াল বন্ধের সিদ্ধান্তে বিরক্ত খোদ অপরাজিতাও । তাঁর কথায়, যে সিরিয়ালের টিআরপি কম সেগুলো চলছে। আর টিআরপিতে তাঁদের সিরিয়াল এগিয়ে, স্লটলিডার, শেয়ার বেশি, তবু সেই সিরিয়ালকেই বন্ধ করে দেওয়া হল । তাঁর কাছে গোটা বিষয়টাই হাস্যকর ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন দ্রুত বন্ধ হচ্ছে ধারাবাহিকগুলি ?
টেলিপাড়া বলছে, দর্শক আর রেটিং চার্টের উপরেই ধারাবাহিকের ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে । যে ধারাবাহিকের টিআরপি ভাল, সেই ধারাবাহিক টিকে যাচ্ছে । নবীন-প্রবীণ অভিনেতারা বলছেন, টিআরপি সবটা নিয়ন্ত্রণ করে। রেটিং ভালো না হলে বিজ্ঞাপন আসে না । তাই, বন্ধ হয়ে যায় ধারাবাহিক । আবার কেউ বলছেন, মানুষের রুচি বদলেছে । সেই অনুযায়ী চ্যানেল কর্তৃপক্ষ বলছেন কোন দৃশ্য হবে, কোন দৃশ্য হবে না । এতে বদলে যাচ্ছে গল্প । অনেকে আবার দোষ দিচ্ছেন দুর্বল চিত্রনাট্যকে ।
লীনা গঙ্গোপাধ্যায়, ইন্দ্রাশিস আচার্যরা বলছেন দর্শকের এখন আর আগের মতো ধৈর্য নেই । বিশেষ করে করোনা পিরিয়ডের পরের থেকে । এছাড়া, এখন বিনোদনের অনেক বিকল্প রয়েছে । তাই দর্শক যতদিন দেখবেন, ততদিন সিরিয়াল চলবে।
ধারবাহিক দ্রুত যেমন বন্ধ হচ্ছে, তেমনই একাধিক নতুন সিরিয়ালও আসছে । সম্প্রতি সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে, পুবের ময়না, কে প্রথম কাছে এসেছি, শুভ বিবাহ । কিন্তু, এই ধারাবাহিকগুলি কতদিন স্থায়ী হয়, তা সবটাই নির্ভর করছে টিআরপির উপর । এমনটাই মনে করছেন অভিনেতা, পরিচালক থেকে বিনোদন জগতের কলাকুশলীরা ।