নামটা কী খুব চেনা মনে হচ্ছে। বলা হয় মানুষের স্মৃতি নাকি খুব ছোট। সেই মস্তিকে নাকি খুব বেশিদিন একটা নাম মনে থাকে না। তাই, ইয়াকুবের নাম হয়তো স্মৃতির অতলেই চলে যাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এই যুবককে কী ভুলে গিয়েছে উত্তর প্রদেশের ঝাঁসি ?
দিনটা ছিল ১৫ নভেম্বর। মধ্যরাতে সরকারি হাসপাতালে তুমুল হইচই। আগুন লেগে মৃত্যু হয় ১৮ জন সদ্যজাতের। সদ্য বাবা হয়েছিলেন ইয়াকুব। নিজের সন্তানকে প্রথমে ওই আগুনের হাত থেকে বাঁচাতে পারতেন। কিন্তু নিজের সন্তানের কথা ভুলে, প্রথমে তিনি ঝাঁপিয়েছিলেন বাকি শিশুদের উদ্ধারের জন্য।
আসলে এমন ইয়াকুব অনেক আছেন, যাঁরা গত পাঁচ বছরে নিজের জীবনকে বিপন্ন করেছেন। কখনও সফল হয়েছেন, আবার ব্যর্থ। এমনটাই দাবি করেছে সর্বভারতীয় দৈনিক দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। সম্প্রতি তারা একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। যে রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, গত পাঁচ বছরে দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ১০৭ জনের। অভিযোগ সেই একটাই, সরকার উদাসীন।
কোভিড। এই তিনটি শব্দ, এখনও আম-জনতার রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। নিজেদের রিপোর্টে ওই ইংরেজি দৈনিক দাবি করেছে, এই কোভিড কালের কার্যত জতুগৃহে পরিণত হয় সাত রাজ্যের সরকারি মোট ১১টি হাসপাতাল। ২০২১ সালে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভেসে গিয়েছিল ভারত। আর এই সময় সরকারি হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল বলে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস তাদের রিপোর্টে দাবি করেছে। প্রতি ক্ষেত্রেই উঠে এসেছে সরকারি উদাসীনতার অভিযোগ।
সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের ঝাঁসির ঘটনায় সরকারি হাসপাতালে আগুন লাগার পিছনে শট-সার্কিটকেই দায়ী করেছে যোগী সরকার। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের দাবি, গত পাঁচ বছরে প্রতি ক্ষেত্রেই কার্যত এই অজুহাতকেই সামনে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু আশু কারণ বলছে অন্য কথা।
সাত রাজ্যের ১১ হাসপাতাল ঘুরে সর্বভারতীয় ওই ইংরেজি দৈনিকের অভিযোগ, প্রতি ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে রয়েছে পরিকাঠামোর ক্রটি। বেশির ভাগ থেকেই মানা হয়নি অগ্নিবিধি। সরকারি বিধি বেশ কিছু ক্ষেত্রে ভঙ্গ করা হয়েছে। গত পাঁচ বছরে বিজেপি শাসিত রাজ্যে বেশি ঘটনা। সরকারি গাফিলতিতেই ভুগতে হয়েছে রোগী ও পরিবারকে।
ফ্ল্যাশব্যাকে ২০১১। এমনই এক ডিসেম্বর। ক্যালেন্ডারে ৯ তারিখ। কলকাতার ঢাকুরিয়ার তৎকালীন আমরি হাসপাতালে ভোররাতের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ১৩ বছর পরেও দগদগে রাজ্যের সরকারি হাসপাতালে আগুন লাগার মানচিত্রে। সেই ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল ৮৯ জনের। এই সময়ের মধ্যে রাজ্যের একাধিক সরকারি হাসপাতাল পুড়েছে। কিন্তু জাতীয় দৈনিক যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, তাতে কিন্তু বাংলার নাম নেই। বরং গত পাঁচ বছরের পরিসংখ্যানে বার বার উঠে এসেছে বিজেপি শাসিত গুজরাত, মহারাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রদেশের নাম।
জাতীয় দৈনিকের দাবি, কোভিড কালে সরকারি হাসপাতালের সবচেয়ে আগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল নরেন্দ্র মোদীর নিজের রাজ্য গুজরাতে। ভারুচের এক সরকারি হাসপাতালে আগুনে জ্বলছে মারা গিয়েছিলেন ১৮ জন। পাঁচ বছর পরেও সেই ঘটনার মামলা আদালতে এখনও চলছে। এই ঘটনায় অভিযুক্ত নয় জনের জামিন হয়ে গিয়েছে।
গুজরাতের আর এক শহর আমেদাবাদ। সরকারি হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ গিয়েছিল আট জনের। এই ঘটনাতেও জামিন পেয়েছেন তিন অভিযুক্ত। মামলা এখনও চলছে। রাজকোটের সরকারি হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছিল পাঁচ জনের। বিজেপি শাসিত এই রাজ্যে এই ঘটনায় জামিন হয়েছে পাঁচ অভিযুক্তের। মামলা চলছে।
তালিকায় রয়েছে বিজেপি শাসিত আর এক রাজ্য মহারাষ্ট্র। বিরারের সরকারি হাসপাতালে ২০২১ সালে আগুন লেগে মারা গিয়েছিলেন ১৫ জন। তাতে কী, অভিযোগ এই ঘটনায় ফৌজদারি কোনও মামলা দায়ের হয়নি। আদালতে মামলা চলছে, তার মধ্যে জামিন পেয়েছেন দুই অভিযুক্তের। ১১ জনের মৃত্যু হয় মুম্বইয়ে। ইতিমধ্যে জামিন দুই অভিযুক্তের।
আহমেদনগরের ঘটেছিল একই ঘটনা। ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল ১১ জনের। গত পাঁচ বছরে অভিযোগ মামলাই শুরু হয়নি। কারণ, মামলা করার ছাড়পত্র দেয়নি সরকার। আরও করুণ ভাণ্ডারার ছবি। ১০ জনের মৃত্যুর পর কোনও ফৌজদারি অভিযোগই দায়ের হয়নি।
তালিকায় রয়েছে আর এক বিজেপি শাসিত রাজ্য মধ্যপ্রদেশ। জব্বলপুরের এই ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল আট জনের। অভিযোগ তৎকালীন শিবরাজ সিং চৌহান সরকার এই ঘটনার কোনও অভিযোগই দায়ের করেনি। কোভিড কালে কোয়ারেন্টাইন হয়েছিল অনেক হোটেল। তারমধ্যে ছিল অন্ধ্রপ্রদেশের বিজয়ওয়ারার সানরাইজ হোটেল।
সেই হোটেলে আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিলেন ১০ জন। সেই মামলা এখনও চলছে। তার মধ্যেই জামিন মঞ্জুর হয়েছে অভিযুক্ত পাঁচ জনের। জাতীয় দৈনিকের দাবি, গত পাঁচ বছরে এই চার রাজ্যের বাইরে আরও তিনটি রাজ্য রয়েছে যেখানে সরকারি হাসপাতালে আগুন লাগার ঘটনার পর শুধু প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন নিহতের পরিবার।