অফিসে কাজের অস্বাভাবিক চাপে মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। কর্ম সংস্কৃতি পাল্টান, এই মর্মে সংশ্লিষ্ট সংস্থার চেয়ারম্যানকে চিঠি পাঠালেন মৃতার মা।
মাত্র চার মাস আগে আর্ন্সট অ্যান্ড ইয়ং ইন্ডিয়ার পুনের অফিসে কাজে যোগ দিয়েছিলেন ২৬ বছরের তরুণী। অতিরিক্ত কাজের চাপই মেয়ের মৃত্যুর কারণ, বলছেন তরুণীর মা। মেয়ের শেষকৃত্যে অফিসের কেউ আসেনি, চেয়ারম্যানকে লেখা চিঠিতে সে কথাও উল্লেখ করেছেন মৃতার মা। তাঁর আর্জি, মেয়ের মৃত্যু অন্তত সবার চোখ খুলে দিক, কর্ম সংস্কৃতি পাল্টাক। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কাজ করানো বন্ধ হোক।
সংস্থার তরফ থেকে কর্মীর মৃত্যুতে শোকজ্ঞাপন করে জানানো হয়েছে, ভবিষ্যতে তাঁরা কর্ম সংস্কৃতি উন্নত করার দিকে মন দেবেন।
২৬ বছরের আন্না সেবেস্টিয়ান পেরাইলের মা অনিতা অগাস্টিন EY India-এর চেয়ারম্যান রাজিব মেমানিকে চিঠি লেখার শুরুতেই জানিয়েছেন, তাঁর হ্রদয় ভেঙে গিয়েছে, তবু অন্য কোনও পরিবারকে যাতে এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে না হয়, তার জন্য এই চিঠি লেখা দরকার। গত বছর ২৩ নভেম্বর চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পাশ করে চলতি বছর মার্চে আন্না পুনের অফিসে যোগ দিয়েছিলেন।
তাঁর প্রাণোচ্ছল মেয়ের মনে ভবিষ্যৎ নিয়ে একগুচ্ছ স্বপ্ন ছিল। জীবনের প্রথম চাকরি এমন নামী সংস্থায়, কাজ নিয়ে দারুণ উৎসাহ ছিল। ''কিন্তু চার মাসের মধ্যে, ২০ জুলাই আমার কাছে সেই ভয়াবহ খবরটা এল। আমার ২৬ বছরের মেয়েটা চলে গেল"।
মেয়ে লড়াকু ছিল, স্কুল কলেজে সবসময় প্রথম হয়েছে, পড়াশোনার পাশাপাশি নানা কিছুর সঙ্গে যুক্ত ছিল তাঁর মেয়ে। চিঠিতে উল্লেখ করেছেন মা। এই সংস্থার ক্লান্তিহীন ভাবে কাজ করত তাঁর মেয়ে, কিন্তু কাজের চাপ, কাজের পরিবেশ, কাজের দীর্ঘ সময় মেয়ের শরীর মনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছিল। ক্রমশ ঘুমহীনতা, উদ্বেগ, মানসিক চাপ মেয়েটাকে গ্রাস করতে থাকে।
মেয়ের সমাবর্তনের জন্য বাবা-মা জুলাইয়ের ৬ তারিখ পুনে যান। আন্না জানান, রাত একটায় কাজ থেকে ফেরার সময় বুকে কেমন চাপ অনুভব করেন। হাসপাতালের নিয়ে যাওয়া হয় আন্নাকে। ইসিজি রিপোর্ট স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু ডাক্তার বলেছিলেন, খুব দেরি করে খাওয়া দাওয়া করছেন তাঁর মেয়ে। পর্যাপ্ত ঘুম হচ্ছে না তাঁর। ডাক্তার অ্যানটাসিড দিয়েছিলেন।
তারপরেও অনেক কাজ পড়ে আছে, এই ভেবে মেয়ে হাসপাতাল থেকেও অফিসে যান, ৭ তারিখ মেয়ের কনভোকেশনের জন্য ওয়র্ক ফ্রম হোম ছিল, ছুটি পাননি আন্না। বিকেল পর্যন্ত বাড়ি থেকে কাজ করে কনভোকেশনের জন্য বেরোন সপরিবারে, পৌঁছোতেও যথারীতি দেরি হয়। মাত্র দু দিনের জন্য মা বাবা পুনেতে গিয়েছিলেন, সেই শেষ একসঙ্গে সময় কাটানো। কিন্তু তখনও কাজের চাপে বাবা-মায়ের সঙ্গে একটু আনন্দ করে কাটাতে পারেননি ওই তরুণী।
অফিসের কাজের বাইরেও কাজ দেওয়া হতো তাঁকে, ছুটির দিনে, অফিসের সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর রাতেও কাজ করতে হতো। রাতে কাজ দিয়ে পরের সকালের মধ্যে কাজ শেষ করতে বলতেন ম্যানেজার। প্রশ্ন করলে ম্যানেজার বলতেন, "এভাবেই সবাই কাজ করে, দরকারে রাতে কাজ করবে"।
চারমাসে এমন দিনও গিয়েছে, বাড়ি ফিরে পোশাক না বদলেই ক্লান্তিতে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছেন আন্না। সে সময়েও অফিস থেকে মেসেজ এসেছে অন্য কোনও রিপোর্ট জমা দেওয়ার জন্য। চিঠিতে অনিতা বারবার উল্লেখ করেছেন, তাঁর লড়াকু মেয়ে এত তাড়াতাড়ি হাল ছাড়ার মেয়ে ছিল না, অভিজ্ঞতা বাড়াতে চেয়েছিল, কিন্তু এত বেশি অভজ্ঞতা ওকে বাঁচতে দিল না। নিজেকে প্রমাণ করার মরিয়া চেষ্টা করেছিলেন তাঁর মেয়ে।
মৃতার মা আক্ষেপ করেন, তাঁরা মেয়েকী এটা বোঝাতে পারেননি, তাঁদের কাছে আর সবকিছুর চেয়ে জরুরি ছিল মেয়ের ভাল থাকা।
আন্না ম্যানেজারদের বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠানোর মেয়ে ছিল না, কিন্তু মা হয়ে তিনি সেটাই করবেন, লেখেন অনিতা। নতুন কর্মীরা সংস্থায় কাজ করতে এলে ম্যানেজাররা সেই সুযোগ নিয়ে কর্মীদের অহেতুক বেশি কাজ করান। শুধু তাঁর মেয়ের ক্ষেত্রে এমনটা হয়নি, বরং এটা কর্ম সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেয়ের শেষ কৃত্যে অফিসের কেউ এল না পর্যন্ত, চিঠিতে সেই অভিমানও আড়াল করেননি মৃতার মা। তাঁর প্রশ্ন, টুকু সহমর্মিতা দেখানো যেত না আন্নার পরিবারকে, তাঁদের এই অন্ধকার সময়ে?
আন্নার এই করুণ পরিণতি, আন্নার মায়ের চিঠি এখন সারা দেশের মানুষের কাছে আলোচনার বিষয়। ভারতের অফিসের নেতিবাচক কর্ম সংস্কৃতি নিয়ে এই প্রথম কোনও ছবি সামনে এল, তা কিন্তু নয়। গত মাসেই বেঙ্গালুরুর এক ঘটনা সামনে এসেছিল। অভিমানে চাকরি থেকে ইস্তফা দিলেন বেঙ্গালুরুর ৩৭ বছরের অধ্যাপক, কারণ, নিজেকে উজার করে দেওয়া সত্ত্বেও বছরের পর বছর বেতন বাড়ছিল না ইঞ্জিনিয়রিং কলেজের সহকারী অধ্যাপকের। হালে আবার ইপিএফ দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছিল প্রতিষ্ঠান। নিজের ইস্তফাপত্রটি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে অধ্যাপক জানিয়েছিলেন, কেন চাকরি ছাড়ছেন, সেই প্রশ্নটুকু পর্যন্ত কেউ করল না তাঁকে।
অধ্যাপক সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে জানিয়েছেন, বিগত ১০ বছর ধরে পূর্ব বেঙ্গালুরুর একটি ইঞ্জিনিয়রিং কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। ২০১৯-এর পর থেকে ছবিটা অনেক পাল্টেছে। কলেজের অন্য তিনটি শাখা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে নতুন অধ্যক্ষ আসার পর। তারপর থেকে তাঁর বেতন বাড়েনি বলেও দাবি ওই অধ্যাপকের। পড়ুয়ারা তাঁর পড়ানোয় খুশি, নিজের টাকা খরচ করে কতবার NAAC-এর অ্যাক্রেডিশনের এন্ট্রি ফি, নানা প্রতিযোগিতার জন্য কলেজের তরফে এন্ট্রি ফি তিনি দিয়ছেন বলেও দাবি তাঁর।
ক্লাস শেষে রাত ৮/৯ টা পর্যন্ত কলেজে কাজ করেছেন, এমনকী রবিবারও কাজ করেছেন। অথচ মাইনে বাড়ার বেলায় জুনিয়রদের বেড়ছে, তাঁর ইপিএফ দেওয়া বন্ধ হয়েছে।