বাঘ ভালবাসেন? ন্যাশনাল পার্ক বা চিড়িয়াখানায় গিয়ে বাঘের হুঙ্কারে পিলে চমকে ওঠে? ভয় থাকুক বা ভালবাসা, 'প্যান্থেরা টাইগ্রিস'-কে নিয়ে মানুষের নানা ধরনের উৎসাহের শেষ নেই! তার শিকার করার পদ্ধতি থেকে গায়ের চামড়া, মানুষখেকো নাকি শুধুমাত্র মাংসাশী, এক থাবাতে কতটা মাংস তুলে নেয় থেকে শুরু করে বাঘের দুধ- বাজারে সত্যিই পাওয়া যায় কি না, বাঘ সংক্রান্ত এমন নানা আলোচনা সাধারণ মানুষের জীবনেও নানা সময় নানাভাবে জায়গা পেয়ে যায়। দেশের জাতীয় পশু হিসেবেও স্বীকৃতি দেওয়া হয় রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারকেই।
তবে, চিড়িয়াখানায় খাঁচার মধ্যে বাঘ দেখা আর খোলা জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে থাকা বাঘ দেখার অভিজ্ঞতা এক নয়। ভারতে বেশ কিছু জাতীয় উদ্যান, ‘টাইগার রিজার্ভ ফরেস্ট’ রয়েছে, যেখানে ঘুরতে গেলে বাঘ দেখা যায় হামেশাই। তবে বর্ষাকাল অর্থাৎ জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সব জঙ্গল বন্ধ থাকে। অনেকেই বলেন, এই সময়েই বন্যপ্রাণীদের প্রজননের পক্ষে আদর্শ। সে কথা মাথায় রেখেই এই নির্দিষ্ট সময়টুকু জঙ্গলে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।
রাজস্থানের রণথম্ভোর, মধ্যপ্রদেশের বান্ধবগড় বা কানহা, মহারাষ্ট্রের পেঞ্চ, উত্তরাখণ্ডের জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক- ভারতে পর্যটক এবং ব্যাঘ্রপ্রেমীদের উপভোগ করার জন্য আকর্ষণীয় টাইগার রিজার্ভের অভাব নেই। গোটা দেশে এতদিন মোট ৫৬'টা টাইগার রিজার্ভ ছিল। এবার, সেই তালিকায় যুক্ত হল নতুন একটি নাম। রাতপ বা রাতাপানি টাইগার রিজার্ভ। যা নিয়ে কার্যত উচ্ছ্বসিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও।
কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ দফতর বাঘ সংরক্ষণের লক্ষ্যে আইন সংশোধন করে 'টাইগার রিজ়ার্ভ' তৈরি করেছিল। বাঘ সংরক্ষণ পরিচালনায় তৈরি করেছিল 'ন্যাশনাল টাইগার কনজার্ভেশন অথরিটি'। ১৯৭৩ সালে মোট ৯টি টাইগার রিজার্ভ নিয়ে শুরু হয়েছিল 'প্রোজেক্ট টাইগার'। ১৯৭২-এর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ২০০৬-এ সংশোধিত হওয়ার পরে ভারতে টাইগার রিজার্ভের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। টাইগার টাস্ক ফোর্সের ১৯৭২ সালে একটি রিপোর্ট পেয়েই এই প্রকল্প শুরু করতে উদ্যোগী হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ভারতের জাতীয় পশুর সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে দ্রুত তৎপর হয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৩ সালের নভেম্বরে কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রক 'ব্যাঘ্রপ্রকল্প' কর্মসূচি শুরু করেছিল।
সংরক্ষণবাদীদের বিশ্বাস, বাঘ সংরক্ষণ করতে গেলে সেখানে মানুষকে কাজ করতে দেওয়া যাবে না। ফলে টাইগার রিজার্ভ অঞ্চলে অধিবাসীদের জোর করে উৎখাত করা হয় নামমাত্র পুনর্বাসন দিয়ে। তা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে দেশের একাধিক অঞ্চলে বিক্ষোভ এবং বিদ্রোহও হয়েছে।
কেন্দ্রীয় দফতর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন দ্বারা যুগ-যুগ ধরে জঙ্গলে বসবাসকারী মানুষের জমির অধিকারের ফয়সালা না করে, তাঁদের মতামত অগ্রাহ্য করে একের পর এক অঞ্চলকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত বহু বছর আগেই। বন্যপ্রাণী ও মানুষের সহাবস্থান অসম্ভব, এই অবৈজ্ঞানিক মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে এ সব অঞ্চলে বাসিন্দাদের উৎখাত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞরাও।
২০০৬ থেকে টাইগার রিজার্ভের দ্রুত বৃদ্ধি ও জনজাতিদের উৎখাতের মাত্রা বৃদ্ধি শুরুর সময়ে ইউপিএ সরকার জঙ্গলের অধিকার ও পরিচালনায় জঙ্গলে বসবাসকারীদের নিয়ন্ত্রণ স্বীকার করে 'বন অধিকার আইন ২০০৬' প্রণয়ন করে- এই আইনে সব সংরক্ষিত অঞ্চলে জঙ্গলে বসবাসকারীদের অধিকার সুরক্ষিত। 'ক্রিটিক্যাল ওয়াইল্ডলাইফ হ্যাবিট্যাট' নামের কিছু এলাকাকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য বাদ রাখা হয়। সেই আইনেই বলা হয়, সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের উৎখাত করতে হলে তাঁদের অনুমতি নিয়ে পুনর্বাসন প্রকল্প সম্পন্ন করার পরেই তবেই তাঁদের সবাইকে স্থানান্তরিত করা যাবে।