চার বারের কেন্দ্রীয়মন্ত্রী, বর্তমানে তিনি, তিন বারের মুখ্যমন্ত্রী। এই পরিসংখ্যানের পরে ইন্ডিয়া জোটের অন্দরে রিংটোন একটাই, মমতা ছাড়া ইন্ডিয়া ব্লক হয় না !
গত লোকসভা ভোটের আগে থেকেই এই রিংটোন বেজে আসছে বিরোধী জোটের অন্দরে। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত জাতীয় রাজনীতিতে মোদী বিরোধী মুখ হিসাবে মমতার পক্ষেই প্রথম সওয়াল করেছিলেন প্রবীণ নেতা শরদ পাওয়ার। এই মারাঠি নেতার হাত শক্ত করেছিলেন আর এক মারাঠি উদ্ধব ঠাকরে।
আসছে বছর দিল্লি ও বিহারের মতো রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভার ভোট। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত লোকসভা নির্বাচন এবং সদ্য শেষ হওয়া মহারাষ্ট্র ভোটের ফল থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার মমতার প্রতি আস্থা দ্বিগুণ হয়েছে। তাই, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আপ, অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি, দক্ষিণের ওয়াইএসআর কংগ্রেসের মতো দল ইতিমধ্যেই তৃণমূল নেত্রীর হাত শক্ত করেছে। ইন্ডিয়া জোটের অন্দরে কংগ্রেসের আপত্তি উড়িয়ে মমতার হয়েই এবার ব্যাট ধরলেন আরজেডি নেতা লালু প্রসাদ যাদব।
মহারাষ্ট্র নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরেই কংগ্রেসের দিকে সন্ধির হাত বাড়িয়েছিলেন তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। আগামী বছর বড় রাজ্যগুলিতে বিধানসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে শ্রীরামপুরের সাংসদের প্রস্তাব ছিল ইগো ছেড়ে তৃণমূল নেত্রীর নামের উপরেই সিলমোহর দিক শতাব্দী প্রাচীন এই রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, লোকসভা ভোটের পাশাপাশি মহারাষ্ট্রের ফল বিশ্লেষণ করে ইন্ডিয়া জোটের অন্দরেই প্রশ্ন উঠেছিল রাহুলের নেতৃত্ব নিয়ে।
বিজেপি অপ্রতিরোধ্য নয়। ২০১৯ থেকে ২০২৪ গত পাঁচ বছরে লোকসভা হোক বা বিধানসভা, পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতিতে বারবার প্রমাণ করে দিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত লোকসভা নির্বাচনের পরেও বঙ্গে বিজেপির উত্থানের একটা জিগির উঠেছিল। তাও ধরাশায়ী হয়েছে মমতার উন্নয়ন জাদুকে। ম্যাজিকের মতো কাজ করেছিল লক্ষ্মীভাণ্ডার প্রকল্প।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, লোকসভার পিচে গতবার সবচেয়ে কঠিন ম্যাচ খেলতে হয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কারণ, দুর্নীতিতে অস্ত্র করে যে ভাবে ভোট প্রচারে এসে বাংলার শাসক দলের উপর চাপ তৈরি করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ, তাতে অন্য কোনও রাজনৈতিক দল হলে তার ভিত নড়ে যেতে পারত।
এরসঙ্গে ছিল জোটে থেকেও বাংলায় বাম-কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ব্যাট করতে নামা। বঙ্গে কংগ্রেসের ভাল ফল চেয়েছিলেন রাহুল গান্ধীও। তাই লোকসভায় বাংলায় তৃণমূলের সঙ্গে জোট তৈরিতে আগ্রহী ছিলেন রাহুল। অন্তরায় হন তৎকালীন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরী। যার খেসারতও দিতে হয়েছে কংগ্রেসও। দোসর বামেরা।
একদিকে, বিজেপির প্রবল চাপ, অন্যদিকে ডান-বামের জোট। তার মধ্যেও রাজ্যের বিয়াল্লিশ আসনে নিজের ক্যারিশ্মাতেই ঘাসফুল ফুটিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। ২৯ আসনে জিতে বিজেপিকে নামিয়ে দিয়েছিলেন ১২ আসনে। রাজ্য থেকে কংগ্রেসের প্রাপ্তি ছিল এক। বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে, গত লোকসভা ভোটে তৃণমূলের ভোট বেড়েছে দুই শতাংশের বেশি। উল্টোদিকে বিজেপির ভোট কমেছে এক শতাংশের বেশি।
আজ থেকে তিন বছর আগে রাজ্য বিধানসভার ভোটে ২৯৪ আসনের মধ্যে ২১৫ আসনে জিতে বাংলায় সরকার তৈরি করেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। রাজনীতির কারবারিরা মনে করেন, গত ১৩ বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ্যমন্ত্রীত্বের কেরিয়ারে তাঁকে সবচেয়ে বেশি বেগ দিয়েছিল আরজি করের ঘটনা।
যার পরবর্তী সময়ে রাজ্যে হয়েছে ছটি বিধানসভা আসনে উপ-নির্বাচন। কিন্তু তারপরেও দেখা গিয়েছে তৃণমূল অপ্রতিরোধ্য। রাজ্যে লোকসভা ভোট পরবর্তী সময়ে ১০টি বিধানসভার উপ-নির্বাচনেই জিতেছে বাংলার শাসক দল। ফলে বর্তমান বিধানসভায় তাদের আসন সংখ্যা এখন ২২৫। ৭৭ থেকে বিজেপি এসে দাঁড়িয়েছে ৬৬ আসনে।
গত লোকসভা ভোটের আগে দিল্লিতে ইন্ডিয়া জোটের শেষ বৈঠকে তৃণমূল নেত্রীর প্রস্তাব ছিল বিজেপিকে রুখতে বিরোধীদের মুখ কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে। বিরোধী জোটের কারিগর হয়েও নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন নেতৃত্ব থেকে। কিন্তু এবার ইন্ডিয়া জোটের অন্দর থেকেই উঠল মমতার নামে সমর্থনের জোয়ার। ২০২৯ সালের অনেক আগে থেকে দেশব্যাপী বিজেপি বিরোধী প্রচারে নিজেদের হোমওয়ার্ক তৈরি রাখতে চান লালু-শরদ-উদ্ধব ঠাকরেরা। সৌজন্যে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।