এই সংখ্যাকে বিশ্লেষণ করতে বসে অনেক সংখ্যাতত্ত্ববিদ দাবি করেন নার্ভাস তত্ত্বের কথা। বাস্তবেও একাধিকবার সেই ছবি দেখা গিয়েছে। বিশেষ করে ক্রিকেটের বাইশ গজে একাধিকবার নড়বড়ে নব্বইয়ে দাঁড়িয়ে ক্রিজ ছাড়তে হয়েছে সচিন তেন্ডুলকর, ব্রায়ান লারার মতো তাবড়ও তারকাকে। আবার শর্তবর্ষের আগেই থমকে গিয়েছে বহু মহান ব্যক্তির জীবন।
কিন্তু ১৯৯১। নার্ভাস নয়, বরং এই সংখ্যাই আমূল বদলে দিয়েছিল ভারতের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটকে। সৌজন্যে মনমোহন সিং। টালমাটাল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দিল্লির মসনদে সরকার নিয়ে ফিরেছিল কংগ্রেস। সোনা নয়, স্রেফ কাঁটা ছিল নরসিমা রাওয়ের মাথার উপর।
৭১ জনের মন্ত্রিসভায় অনেকেই ছিলেন। কিন্তু এমন কেউ ছিলেন না, যিনি এই দেশের সমাজ-অর্থনীতিতে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দিতে পারেন। দরকার ছিল এমন একজন অর্থমন্ত্রীর, যিনি দেশজ পদ্ধতিতে বিদেশি পুঁজি ভারতলক্ষ্মীর ভাঁড়াড় ভরাতে পারবেন।
কে হতে পারেন ?
প্রথমে উঠেছিল অনেক নাম। কিন্তু সেই খোঁজে শেষ পর্যন্ত নরসিমা রাও সিলমোহর দিয়েছিলেন মনমোহন সিংয়ের নামেই। কারণ, দীর্ঘ সময় দুঁদে রাজনীতিক নরসিমার নজরে ছিলেন মনমোহন। বিশেষ করে আটের দশকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হিসাবে দেশের অর্থনীতিকে কার্যত খাদের কিনারা থেকে তুলে আনার যোদ্ধার নাম ছিল মনমোহন সিং। পরবর্তী সময়ে যোজনা কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দায়িত্ব সফল ভাবে সামলে ছিলেন কেমব্রিজ পাসআউট।
সেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের আহ্বানে অর্থমন্ত্রকের সদর দরজা খুলে গিয়েছিল মনমোহনের সামনে। সেই চেয়ার বসে একের পর এক মনমোহিনী সিদ্ধান্ত। দুরন্ত ঘূর্ণির মতোই ঘুরল ভারতীয় অর্থনীতি।
বিশ্বের মঞ্চে আর্থিক ভাবে ভারতকে শক্তিশালী হতে হলে, তাদের বাজারকেই এই দেশে নিয়ে আসতে হবে। এটাই ছিল তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের টোটকা। যে দাওয়াই ভ্রু কুঁচকে ছিলেন আম্বানি, বিড়লা, মহিন্দ্রার মতো ব্যবসায়ীরা। সমর্থন করতে বন্ধু মনমোহনকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ছিলেন একমাত্র রতন টাটা।
নারায়ণ মূর্তির মতো প্রথম প্রজন্মের শিল্পোপতি দাবি, ৩৩ বছর আগে উদারীকরণের ওই বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তের জন্যই আজ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির স্বপ্ন দেখার সাহস দেখাতে পারে ভারত। চোখ রাঙাতে পারে চিনকে। অনায়াসে মার্কিন বাজারকে কব্জা করতে বাড়িয়ে দিতে পারে সহযোগিতার হাত।
MJ আকবর, প্রণয় রায়ের মতো বিশিষ্টরা মনে করেন, নয়ের দশকের ওই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ভারতীয় বাজারে পশ্চিমের দরজা হাট করার মতো পরিস্থিতি ছিল না। কারণ, স্বাধীনতার পর সেই প্রথম দিল্লির মসনদে কংগ্রেস সরকার তৈরি করেছিল নেহরু-গান্ধী পরিবারের ছায়া থেকে বাইরে এসে। রাজীবের মৃত্যুর পর সনিয়ার রাজনীতিতে আসা ঘিরে ছিল ধোঁয়াশা। কংগ্রেস সভাপতি তখন সীতারাম কেশরী। সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ভারতীয় অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে নরসিমা-মনমোহন কম্বিনেশন ছিল ভারতীয় রাজনীতির কাছে সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ।
তবে, দিল্লির রাজনীতির কারবারিরা মনে করেন, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পদে যে সাহস মনমোহন সিং দেখিয়ে ছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর পদে তাঁকে অনেক বেশি রক্ষাণাত্মক মনে হয়েছে। এর পিছনে অনেকেই মনে করেন রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা। তারমধ্যেও ২০০৮ সালে বামেদের বাধা সত্ত্বেও আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু নিরস্ত্রকরণ চুক্তি, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের প্রথম ইনিংসে অন্যতম বড় সিদ্ধান্ত।
শুধু অর্থনীতি নয়, শাসনকালের দ্বিতীয় ইনিংসে প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের বেশি নজর ছিল সমাজ বদলের দিকে। কপ্টার, টুজি, কয়লার মতো দুর্নীতির কাঁটা মাথায় নিয়েও তৎকালীন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গান্ধীর সঙ্গে পার্টনারশিপে ১৪৫ কোটি দেশবাসীর খাদ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করেছিল তাঁর সরকার। গ্রামের মানুষের রোজগার যাতে নিশ্চিত থাকে, তার জন্য তাঁর উপহার ছিল ১০০ দিনের কাজ। যার পোশাকি নাম ছিল মানরেগা।
পশ্চিমের দুয়ার হাট করতে গিয়ে ভারতের নিজস্ব ভিত্তি কৃষিকে কখনও দুয়োরানি করেননি মনমোহন সিং। বরং গ্রামীণ কৃষকদের শ্রীবৃদ্ধির দিকে নজর ছিল সবসময় তীক্ষ্ণ। ৩৩ বছরের রাজনৈতিক জীবন। আজীবন ছিলেন রাজ্যসভার সাংসদ। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সক্রিয় রাজনীতিতে থেকে যিনি অবসর ঘোষণা করেছিলেন। ২০২৩ সালে শেষবার সংসদে এসেছিলেন তিনি।
সেই ভারতীয় সংসদ, যেখান থেকে ভারতীয় অর্থনীতিকে তিনি ঘুরিয়ে ছিলেন ১৮০ ডিগ্রি। তাঁর হাত ধরেই ভারতীয় শব্দবন্ধে শোনা গিয়েছিল গ্যাটচুক্তি। তাঁর হাত ধরেই জেনারেশন নেক্সটকে ধরে বাজারে এসেছিল নিয়ন পেপসি। প্রাক্তন মনমোহনের স্বপ্নে আজ ট্রিলিয়ান অর্থনীতির দাবি করেন বর্তমান নরেন্দ্র মোদী।